অলৌকিকের মাঝেই লৌকিকতা

সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়


জ্বলন্ত কাঠের উনুন। তার উপর মাটির হাড়ি বা কড়াইয়ে ফুটন্ত ঘি। সেই ঘিয়ের মধ্যে আটার লেচি থেকে হাতে বানানো পিঠে ছাড়া হচ্ছে হাত দিয়ে। হাতা, খুন্তি কিম্বা ঝাঁঝরি নয়, হাত দিয়েই নাড়াচাড়া করে গরম ঘিয়ের কড়াই থেকে পিঠে তোলা হচ্ছে। তারপর নিবেদন করা হচ্ছে কাল্পনিক দেবীর থানে। এই রীতি চলে আসছে চারশো বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে। বাঁকুড়ার তালডাংরা থেকে দু কিলোমিটার দূরে পাকুড়ডিহা গ্রাম। অধিকাংশই সাঁওতাল এবং বাকি গোয়ালা সম্প্রদায়ের বাস। শালবন ঘেরা এই গ্রামটির খবর অনেকেরই জানা সাঁওতাল জনসমাজের মধ্যে প্রচলিত লোক কাহিনীটির দৌলতে।

সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো বছর আগের আদিবাসী লোককাহিনী আজও স্বমহিমায় সজীব। অদৃশ্য শক্তির উপর তাদের বিশ্বাস সেই টোটেমিক যুগ থেকেই। আদিম যুগের কৌম জীবনের ধারায় তারা ছিল সর্বপ্রাণবাদ প্রকৃতির পূজারী। আদিকাল থেকেই তারা বনপাহাড়ে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করার সময় কল্পনা করেছিল প্রকৃতির অমোঘ শক্তি। মানুষ সহ জীব ও জড় জগৎ নিয়ন্ত্রণে একটি অদৃশ্য শক্তির হাত রয়েছে। আজও তারা সেই বিশ্বাসেই আস্থাশীল। আজও বন পাহাড়, বৃক্ষ পূজা তার প্রমাণ।

পাকুড়ডিহা গ্রামেও ঘটেছিল তেমনই এক অলৌকিক কাহিনী। সাত ভাই এবং এক বোনকে ঘিরে আজও আবর্তিত হয় ধর্মীয় লৌকিক উৎসব এবং তাকে উপলক্ষ করে পূজা পার্বণ। ফি বছর মাঘ মাসের তিন তারিখে গ্রামের ফাঁকা মাঠে ‘সাত বহয়া মিতান মিশা’ নামে লৌকিক উৎসব পালিত হয়। গ্রামের প্রবীণ চুনারাম মাণ্ডি লায়া (পুরোহিত) হিসাবে নিয়োজিত। তার কাছ থেকেই জানা যায়, একদিন সাত ভাই গিয়েছিল শিকারে। গভীর বনে শিকারে গিয়ে সাত ভাই হিংস্র জন্তুর আক্রমণের মুখে পড়ে যায়। এরপর থেকে তাদের কোন খোঁজ ছিল না। ভাইয়েরা বাড়ি ফিরে না আসায় চিন্তিত বোন দীর্ঘ একমাস যাবত ব্রত পালন করে। বোনের কঠোর ব্রত পালনে ঘটে অলৌকিক কাণ্ড। একদিন অক্ষত অবস্থায় সাত ভাইই আচমকা বাড়ি ফিরে আসে। বনের লৌকিক দেবীর কাছে মানত করেছিল যে অক্ষত অবস্থায় ভাইয়েরা ফিরে এলে গরম ঘিয়ে হাতে সেঁকা পিঠে বানিয়ে খাওয়াবে নজের হাতে। দীর্ঘ এক মাস ব্রত পালনের সময় বোন তেল মাখা, কাপড় কাচা প্রভৃতি কাজ বন্ধ রেখেছিল। কাল্পনিক সেই দেব-দেবীকে তুষ্ট করবার জন্য হাঁস, কালো ছাগল, পায়রা বলি দেওয়া হয়। সেই বলি দেওয়া পশু পাখির রক্তে আটার লেই বা লেচি ভিজিয়ে মাখা হয়। তারপর গরম ঘিয়ে ভাজা হয় পিঠে।

দেবদেবীর পূজা আরাধনার পর শুরু হয় নাচগান সহ আনন্দ উৎসব। মূল ব্রতীরা এক মাস কঠোর ব্রত পালন করেন। বর্তমানে পাকুড়ডিহা গ্রামে দুটি জায়গায় আলাদা ভাবে এই পূজা উৎসব হয়। এ ছাড়াও রানিবাঁধ থানার রাজাকাটা গ্রামেও একই লোক উৎসবের আয়োজন করেন আদিবাসী মানুষজন। পাকুড়ডিহায় তিরিশ জন ব্রতী দু’ভাগে ভাগ হয়ে অংশ নেয় ধর্মীয় উৎসবে। বহু আদিবাসী এখানে মনোবাসনা পূর্ণ করবার লক্ষ্যে মানত করেন। তারা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে আদিবাসীরা এখানে এসে মিলিত হন। ‘সাত বহয়া মিতান মিশার’ টানে উৎসবে যোগ দেন বহু আদিবাসী মানুষজন।

শুধু নাচ গান নয়, বসে যায় গ্রামীন মেলা। তালডাংরার পাশাপাশি বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামেগুলির মানুষ মেলাটিকে সার্থক করে তোলেন। ভাইদের না হারানোর জন্য যেমন প্রার্থনা থাকে, তেমনই ভাইয়েরাও বোনের নজরের আড়াল করতে চায় না। এক লৌকিক উপাখ্যানকে উপলক্ষ করে বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষজন একটি মিলনোৎসব, আবেগ এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সযত্নে।

পাকুড়ডিহা গ্রামে এলে খুব সহজেই গরম ঘিয়ে ভাজা পিঠে হাতে তোলার এই ছবির দেখা মিলবে। ফুটন্ত কড়াই থেকে অনায়াসে এই গরম পিঠে তোলার সময় চূনারাম বাবুর অভিব্যক্তিও বেশ স্বাভাবিক। একে কি বলা যায় অলৌকিক না দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সে যাই হোক, আসলে প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে আমাদের নজরের আড়ালে থাকা এই ধরনের অসংখ্য ঘটনাই বলে দেয় যে আপাত অলৌকিকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে লৌকিকতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − five =