ভাইজ্যাগ – বিশাখাপত্তনম (প্রথম পর্ব)

পলাশ মুখোপাধ্যায়


গত সংখ্যায় আরাকু ভ্রমণের পর এবার আমাদের গন্তব্য বিশাখাপত্তনম বা ভাইজ্যাগ। বঙ্গোপসাগরের তীরে বন্দরনগরী বিশাখাপটনম বা বিশাখাপত্তনম। এই শহরের নামকরণ নিয়ে শোনা যায় একাধিক গল্প। একাদশ শতাব্দীতে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজা বারাণসী যাত্রার সময় বিশ্রাম নিয়েছিলেন এখানে। সেই সময় তিনি কার্তিকের (বিশাখা) মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো করেন। সেই থেকেই জায়গার নাম বিশাখাপত্তনম। ১৭৬৮ সালে এর দখল নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংরেজরা বিশাখাপত্তনম না বলে ভিজাগপটনাম বা ভিজাগ বা ভাইজ্যাগ বলতে শুরু করে। ভাইজ্যাগ একটি ব্যস্ত বাণিজ্য কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা কেন্দ্র। এখানে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর। আর আছে সরকারি ইস্পাত কারখানা, ভারী শিল্প উদ্যোগ এবং ভারতের সর্ববৃহৎ জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র। আবার কারও মতে ভাল্লুরের হিন্দু দেবতা বিশাখার নাম অনুসারে এই শহর। সে যাইহোক পূর্বঘাট পর্বতমালার কোলে বঙ্গোপসাগরে তীরেবিশাখাপত্তনম একটি প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় এবং আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

আরাকু থেকে ফিরে আমাদের ভাইজ্যাগ ভ্রমণ শুরু হল সীমাচলমমন্দির দর্শনের মাধ্যমে। সীমাচলম মন্দিরটি ভাইজ্যাগ থেকে ১৬ কিঃমিঃ দূরে পাহাড়ের উপর ১১ শতকে তৈরি। মন্দিরে আছে বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারের মূর্তি যাতে সব সময় চন্দনের প্রলেপ লাগান থাকে। অসংখ্য ভক্ত এই মন্দিরে পূজো দিতে আসেন। শোনা যায় শ্রী চৈতন্যদেবও এই মন্দিরে এসেছিলেন। আরাকু ছেড়ে ঘন্টা তিনেক যাত্রার পর গাড়ি এসে দাড়ালো সীমাচলম পাহাড়ের পাদদেশে। এবার উপরে ওঠার পালা। গাড়ি না থাকলে পাহাড়ে ওঠার আলাদা বাসও পাওয়া যায়। পাকদণ্ডী বেয়ে গাড়ি উঠে চললো। নীচের বাড়ি ঘর গাছপালা মন্দির ছোটো থেকে আরো ছোটো হতে লাগলো। মিনিট পনের বাদে গাড়ি এসে থামলো হাজার ফুট উচুঁ পাহাড়ের উপর অবস্থিত সীমাচলম মন্দিরে।

প্রশস্ত মন্দির চত্বর। সহজে মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলে টিকিট কাটতে হয়। টিকিট কেটে দাঁড়ালাম লাইনে, বেশ ভিড়, প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লাগল দেবদর্শনে। টিকিট কেটেই এই অবস্থা, ফ্রী দর্শন লাইনে ভীড়টা তো আরও বেশি। প্রাচীন এ মন্দির। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব সব কারূকার্য। অবশেষে বিগ্রহের সামনে এসে দাড়াঁলাম। ডিম্বাকৃতি পাথরের গায়ে নৃসিংহ দেবের ছোট্ট মূর্তি ভালো করে ঠাওর করা যায় না হলুদ, চন্দন আর ফুলমালার আধিক্যের জন্য। ঠেলা গুতো খেয়ে কোনও রকমে দেবদর্শন সেরে এবার এসে দাঁড়ালাম প্রসাদ কাউন্টারের সামনে, গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে দুটি বড় লাড্ডু প্রসাদ হিসাবে পাওয়া গেল। মন্দিরের নিচের ছোট দোকানগুলি থেকে কিছু কেনাকাটা সেরে এবার চেপে বসলাম হোটেলের উদ্দেশে। বিচ রোডের হোটেলগুলি থাকার জন্য বেশ, সমুদ্রের কাছাকাছি থাকা যায়। আমাদের হোটেলটির অবস্থান অবশ্য ভাইজ্যাগ শহরের মাঝামাঝি জগদম্বা সেন্টারে। সন্ধে হয়েই গিয়েছিল, রাতে আশেপাশের বাজারগুলি এক ফাঁকে ঘুরে নেওয়া গেল।

পরদিন সকাল সকাল শুরু হল ভাইজ্যাগ ভ্রমণ। আগে থেকে বলা থাকায় গাড়ি এসে হাজির হোটেলের নিচে। সমুদ্রকে ডান দিকে রেখে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শুরু হল পথ চলা। কোথাও সমুদ্র আলতো করে পাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে, কোথাও আবার ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। প্রথম গন্তব্য ভিমমুনিপত্তনম। পথের ধারে লাল মাটির পাহাড়ের কাছে ঝাউ বনে ফাঁকে নজরে আসছেপাড়-ঢেউয়ের খেলা। গোস্থানি নদীর মোহনায় ভিমমুনিপত্তনম বা ভিমলি বিচ। এখানে নানা দেবদেবীর মূর্তি ও সন্ন্যাসীদের মূর্তি রাখা আছে। মাঝ দরিয়াতে বেসামাল নৌকাকে মৎস্যজীবীরা কী ভাবে সামাল দেন, তার একটি মূর্তি বড় রাস্তার মাঝে শোভা পাচ্ছে। সুন্দর পরিবেশে জেলেদের গ্রাম। তবে শুঁটকি মাছের গন্ধ সহ্য করতে হল অনেকটা সময়।

সোনালী বালিতে মোড়া রুশিকোন্ডা বিচটি ছবির মত সুন্দর। সমুদ্র, পাহাড় ও ছোট ছোট কটেজ মিলিয়ে এক অপূর্ব দৃশ্য। এখানে ওয়াটার স্পোর্টসেরও বন্দোবস্ত আছে। বিচ থেকে উঠে গেছে উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের কোলে ছবির মত সুন্দর অন্ধ্র প্রদেশের সরকারের পর্যটন বিভাগের রিসর্ট – হারিতার কটেজের সারি। রুশিকোন্ডা বিচের ডান দিকে বেশ বড় বড় পাথর। স্নান করতে নামা বিপদজনক। তবু তার মাঝেই জলে নেমে পড়েছেন কিছু উৎসাহী মানুষ।

রুশিকোন্ডা বিচে আসার পথে পড়বে লাল মাটির পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় রামা নাইডু ফিল্ম স্টুডিও। ছবির মত সুন্দর সাজানো এই ছোট্ট ফিল্ম সিটিতে সিনেমার শুটিং হয়। খানিকক্ষণ ঘুরে দেখতে মন্দ লাগবে না। এখান থেকেও নিচে সমুদ্রের অসাধারণ রূপ দেখা যায় প্রাণ ভরে। বাংলা ছবি এবং টিভি সিরিয়ালেরও শুটিং হয় এখানে। আমাদের সঙ্গেও দেখা হল বাংলা ছবির শুটিং করতে আসা একদল কলাকুশলীর।

এরপরের গন্তব্য থোতলাকোন্ডা। থোতলাকোন্ডা ১২৮ মিঃ পাহাড়ের ওপর একটি প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্ম ও শিক্ষা কেন্দ্র যা ভারতীয় নৌবাহিনীর সার্ভে করবার সময় আবিষ্কার হয়। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সাল নাগাদ মাটি খুঁড়ে অনেক তথ্য ও নির্মানকার্যের ধংসাবশেষ মেলে। এর মধ্যে আছে মহা স্তূপ, ১৬ টি স্তূপ, একটি বড় প্রেক্ষাগৃহ, ১১ টি জলাধার, ৩ টি চৈত্য গৃহ, ৭২ টি কামরা সমেত ১০ টি বিহার, রান্না ঘর, ভোজনশালা, রাস্তা ঘাট ইত্যাদি। ২০০০ বছরেরও পুরনো এই কেন্দ্রে শতাধিক ভিক্ষু থাকতেন এবং ধর্ম চর্চা ও বিদ্যা শিক্ষা করতেন বলে ঐতিহাসিকদের দাবী। বহু মানুষ এখানে পিকনিক করতেও আসেন। অন্য সময় নির্জন এই জায়গাটি ভারি সুন্দর।

ইন্দিরা গাঁধী জুওলজিক্যাল পার্ক হল জাইজ্যাগের চিড়িয়াখানা। তবে আমাদের দেখা আলিপুর চিড়িয়াখানার সঙ্গে একে মেলানো ঠিক হবে না। ৬২৫ একর জায়গা নিয়ে পাহাড় সমুদ্রে ঘেরা এই প্রাকৃতিক চিড়িয়াখানাটি এক কথায় অসাধারণ। ঘুরতেও হয় গাড়ি চেপে। অনেকটা জায়গা নিয়ে পশুরাও থাকে বেশ স্বচ্ছন্দে।

এর পরে গন্তব্য কৈলাশ গিরি। ছোট্ট পাহাড়ের উপরে এক মনোরম প্রমোদ উদ্যান। কৈলাশ গিরির ভিউ পয়েন্ট থেকে বিশাখাপত্তনম শহর এক কথায় অনবদ্য। পাহাড়ের উপরে গাড়ি বা বাস ওঠে। কিন্তু আমরা রোপওয়েকেই বেছে নিলাম। রোপওয়েতে চড়ে পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাও কিন্তু দারুণ। রোপওয়ে থেকে নামতেই আমাদের স্বাগত জানালো মন ভালো করা এক প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রায় তিন বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত নয়ন মনোহর উদ্যান এই কৈলাশগিরি। প্রথমে পাথর আর সিমেন্টের তৈরি লতা, পাতা, ফুল, আঙ্গুর আর কতগুলি হনুমান খোদিত একটি গোল সুউচ্চ গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ পথের ডানদিকে রয়েছে হাওয়া অফিস, যার আকৃতি অনেকটা মশালের মাথায় ফুটবলের মত। বাদিকে রয়েছে বিশাল ফুলঘড়ি ও সংলগ্ন সুন্দর ফুলবাগান। আরো এগিয়ে যেতেই একে একে নজরে পড়ল চার পাঁচটি চিলড্রেনস পার্ক, রকগার্ডেন, স্টোনস্কাল্পচারপার্ক, অবসারভেটরি, লাভারসপার্ক, রোজগার্ডেন, টাইটানিকপয়েন্ট, বিবেকানন্দ ধ্যানভবন এবং আরো কত কিছু। ৮ থেকে ৮০ সবারই মনোরঞ্জনের জন্য কিছু না কিছু উপকরন হাজির সেখানে।

কৈলাসগিরি পাহাড় থেকে গোটা ভাইজ্যাগ সিটিকে দেখতে দারুন লাগে। দুরবীন দিয়ে দেখা যায় সমুদ্রের মধ্যে ভাসমান জাহাজগুলিকে খুব কাছে। ডলফিনের নাকের মত এক পাহাড়, নাম ‘ডলফিন নোজ’ কে হাতের কাছে মনে হয়। উপর থেকে দেখা যায় সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ছে তীরে। শয়ে শয়ে মাছ ধরার নৌকা পাল তুলে ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের বুক চিরে। শ্বেত পাথরের তৈরি বিশালাকৃতি শিব ও পার্বতির মূর্ত্তি দুটিই কৈলাশগিরির মূল আকর্ষণ। তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝরনা। এছাড়াও আছে সোলার এনার্জি পার্ক এবং সর্ব ধর্ম সমন্বয় মন্দির ও সর্ব ধর্ম সমন্বয় স্তম্ভ, যার বুকে আঁকা আছে হিন্দু, মুসলিম, জৈন আর খৃষ্টান ধর্মের প্রতীক ও বাণী। পাশেই আছে সর্ব ধর্ম সমন্বয় উপাসনালয়। সব কিছু ঘুরে দেখতে দেখতেই বিকেল প্রায় শেষ।
বেশ কিছু খাবারের স্টল রয়েছে আসে পাশে। তার মধ্যে একটিকে পছন্দ করে বসে পরলাম আর খাবার অর্ডার করলাম।সঙ্গে সঙ্গেই এসে গেল গরম গরম ধুমায়িত কফি, সিঙ্গারা আর বিউলির ডালের বড়া ও সুস্বাদু চাটনি। খাওয়া সেরে মুগ্ধ মন নিয়ে রোপওয়েতে চড়ে বসলাম নিচে নেমে আসার জন্য।

বিশাখা মিউজিয়ামটিও বেশ চমৎকার। নৌবাহিনীর নানা অচেনা অদেখা বিষয়ের দেজখা মিলবে এখানে।গেলাম বিখ্যাত কুরসুরা সাবমেরিন দেখতেও। সমুদ্রের ধারে রাখা সাবমেরিনটি প্রায় ৯২ মিটার লম্বা ও ৮ মিটার চওড়া। এখানে প্রবেশের জন্যটিকিট কাটতে হয়, ক্যামেরার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া। ডুবোজাহাজটি বেশ পুরনো হলেও তার একটা সমুদ্রতলে জাহাজের নাবিকদের জীবনযাত্রার একটা আভাষ মেলে এখান থেকে।

ইতিমধ্যেই রাত হয়ে এসেছে। চলে এলাম রামকৃষ্ণ বিচে। রামকৃষ্ণ বিচে কিন্তু বেশ ভীড়। প্রচুর লোক সমাগমে মুখর হয়ে উঠেছে চার পাশ। ছোটখাট মেলা বসে গেছে, হরেক রকম পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। কাছেই রয়েছে মা কালীর মন্দির। দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি। সেখানে সন্ধ্যারতি হচ্ছে। মাতৃদর্শন সেরে আমরা এবার এলাম রামকৃষ্ণ আশ্রমে। পাশেই আশ্রম। ধ্যান ও সন্ধ্যা আরতি চলছে এখানেও। এবার ফেরার পালা, পা বাড়ালাম থুড়ি গাড়ি ছোটালাম হোটেলের পথে। ভাইজ্যাগ ভ্রমণ এখানেই শেষ নয়। রয়েছে আরো অনেক কিছু। সে আলোচনাও নিশ্চয় হবে, তবে পরের সংখ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × five =