হোক কলরব, কিন্তু…

চিন্ময় ভট্টাচার্য

“মুখে মুখে কথা বলছে দেখ- একেবারে পিসির মত”
“তুইও বাবার মত একগুঁয়ে হচ্ছিস? “
“বাপির মত রাজনীতিতে ঢুকিস না“ ।
আমরা সবাই বড় হয়েছি কমবেশি এইসব কথাগুলো শুনতে শুনতে। বাবা, মা, স্যরের কথা অক্ষরে অক্ষরে না মানলেই অন্য কারোর সঙ্গে তুলনা টেনে আনা। বিন্দুতে সিন্ধু দেখার মতই অগ্রজের অবাধ্যতার ছায়া দেখে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেবার চেষ্টা। আমি সবিনয়ে এই কথাটা বলতে চাই, সেই সব বাবা মা মাসি সহ সমস্ত অভিভাবকদের কাছে, আমরা কেউ কারোর মত নই। আমরা সবাই আমাদের মত, আমাদের শরীরের মত মন আলাদা, অস্তিত্ব আলাদা। আমরা প্রত্যেকে আলাদা চিন্তা করি, একই বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে ভাবি। হতে পারে কোন একটা বা একাধিক বিষয় নিয়ে কোন দুজন একই সুরে কথা বলছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যাচ্ছে। হরিহর আত্মা মানে দুই বন্ধুকে বেশির ভাগ সময় অথবা সম্ভাব্য সর্বক্ষণ একইসঙ্গে দেখা যায়, একজন যা করে, যেখানে যায় অন্যজনও তাই করে, সেই সুরেই কথা বলে। কিন্তু তার মানে কি, দুজনের অস্তিত্ব এক হয়ে গেল? সেটা যে নয় সে তো নামেই (হরি-হর) প্রমাণ।
এই যে একের মধ্যে অন্যের ভুত দেখতে পাওয়া সেটা বোধহয় সব থেকে সংক্রামক রাজনীতির জগতে। এক মিছিলে হাজির হাজার জনতাকে শুধুই সমষ্টি হিসেবে দেখা। সমষ্টির আড়ালে হারিয়ে যায় ব্যক্তি। দেখা হয় না মিছিলের একটি মুখকে। তারই জন্য ব্যক্তির মত হারিয়ে যায়, সমবেত সংখ্যাগরিষ্ঠের সায়ে হারিয়ে যায় সংখ্যালঘুর প্রতিবাদ। হোক না সংখ্যায় কম, হোক না সংখ্যালঘু তবু তো সেটা একজনের মত। সেই মতটাকে আমরা কবে সম্মান দিতে শিখব? সমষ্টির সমবেত কলরবে হারিয়ে যায় ব্যাক্তির কণ্ঠ। হারিয়ে যায় বলেই আমরা শুনতে পাই না প্রতিটি মানুষ আলাদা স্বরে কথা বলছে।
এর জন্যেই সমস্ত আওয়াজকে এক করে দেখা শুরু হয়। সরকারি দলের কোন কাজের প্রতিবাদ করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিহ্নিত করা হয় বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে। প্রতিপক্ষ তাকে দালাল বলে গালাগাল দিতেও ছাড়ে না। একই লক্ষণ দেখা যায় বিরোধী দলের হর্তাকর্তাদের মধ্যেও। তাদের সমালোচনা করলে হলদে সবুজ ওরাং ওটাং হয়ে যান দল নিরপেক্ষ মানুষও। আর এই করেই তারা সেই মানুষটিকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দিতে থাকে। রাজনীতি থেকে একেবারে ঘরের অন্দরে পর্যন্ত একই সমস্যা। কয়েকদিন আগে এক প্রতিষ্ঠিত কবির সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। কবি এই সময়ের সব থেকে শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষের সমালোচনা করেছেন। তাঁর কবিতার জন্য নয়। বিভিন্ন বিষয়ে প্রবীণ কবির মতামতের জন্য। না, সেই নির্দিষ্ট মতামতের তিনি সমালোচনা করেন নি, পাল্টা কোন যুক্তি তুলে ধরেন নি। তিনি প্রবীণ কবির সমালোচনা করেছেন কারণ তাঁর মনে হয়েছে শঙ্খ ঘোষ কখনও নকশাল, কখনও সিপিএম, কখনও আবার নিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলছেন। এটাই তাঁর কাছে দোষের। এতক্ষণ যে কথাগুলো আলোচনা করলাম, সেই একই ভুল কি এই প্রতিষ্ঠিত কবি করে ফেললেন না ?
বিষয়টি কি আমরা ঘুরিয়ে এইভাবে দেখতে পারতাম না যে বিভিন্ন বিষয়ে শঙ্খবাবু যা মত দিয়েছেন তা ওই সময়ে ওই বিষয়ে ওই রাজনৈতিক দলের মতের সঙ্গে মিলে গেছে? বা ঐ ঐ বিষয়ে তিনি একমত হয়েছেন ঐ ঐ দলের সঙ্গে। তা হলেই তাকে ঐ দলের একজন বলে চিহ্নিত করতে হবে? ওই সাক্ষাৎকারের কোথাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই নি। মানে শুধু বাবা মা কাকারা নন প্রতিষ্ঠিত কবিও একই দোষে দুষ্ট। কোন মতই দলনিরপেক্ষ হতে পারে না, এই বিশ্বাসে অটুট থেকে সবার গায়ে সুযোগ অনুযায়ী তকমা এটে দেওয়া।

হোক কলরব। কিন্তু সেই কলরবে যেন শোনা যায় প্রতিটি মানুষের কলতান। তাতে মিশে থাকুক বিরোধিতাও। মালা তো দেখতে সুন্দরই, কিন্তু সেই মালায় একটি ফুলও যদি না ফোটা থাকে তা কি আর সুন্দর থাকে? সবশেষে এটাই বলার, শতফুল বিকশিত হোক। তাহলে আগাছা আপনিই নির্মূল হয়ে যাবে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − 11 =