মিহি সফরে সীতাভোগের দেশে
পলাশ মুখোপাধ্যায়
যাওয়া মানেই খাওয়াতে এবারে আমরা যাচ্ছি বেশ জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত জায়গায়। হাওড়া থেকে সওয়া ২ ঘন্টার ট্রেন যাত্রাতেই পৌঁছনো যায় বর্ধমান। যাওয়া যায় শিয়ালদহ থেকেও। কলকাতা থেকে ৯৫ কিমি দুরে দামোদর নদীর তীরে অবস্থিত বর্ধমান শহর। ধর্মতলা এবং করুণাময়ী থেকে প্রতিদিন অসংখ্য বাস যাচ্ছে বর্ধমানে। আমি অবশ্য শিয়ালদহ থেকেই বর্ধমান লোকালে উঠে বসলাম। এখান থেকে একটাই ট্রেন দিনে। সময়ও বেশিই লাগে। তা লাগুক, আমার কোন তাড়া নেই। প্রায় ঘন্টা তিনেক পর সাড়ে দশটা নাগাদ পৌছলাম বর্ধমানে। বর্ধমান ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ মাধ্যম হল রিক্সা। স্টেশন থেকেই নেওয়া হল রিক্সা, আমার সঙ্গী হলেন বর্ধমানের সাংবাদিক বন্ধু সৌমেন রায়। এই নিবন্ধের অনেক ছবি সৌমেনেরও তোলা। ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রভৃতি নানা রত্নে ভরা বর্ধমানে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।
প্রথমেই আমার গন্তব্য লর্ড কার্জনের নামাঙ্কিত কার্জন গেট। লর্ড কার্জনের বর্ধমান আগমন স্মরণীয় করে রাখতে তার সম্মানার্থে এই তোরণ নির্মিত হয়। এর বর্তমান নাম বিজয় তোরণ। এই তোরণ বর্ধমান শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কিন্তু শহরের প্রাণ কেন্দ্রে হওয়াতে চারপাশে নানা দোকান বাজারের কোলাহলে কার্জন গেটের স্বাভাবিক সৌন্দর্য প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
শহরান্তের কঙ্কালেশ্বরী কালী মন্দির দেখে এবার সোজা পাড়ি দিলাম সদরঘাটে। বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির এখানে। জাগ্রত মন্দির, তাই জনসমাগমও লেগেই থাকে ফি দিন।
বর্ধমানে এসে বর্ধমানেশ্বরের দর্শন করব না তা কখনও হয়। এবার তাই পা বাড়ালাম থুড়ি রিক্সা বাড়ালাম বাবা বর্ধমানেশ্বরের মন্দিরের দিকে। ১২ শতকের এই শিবলিঙ্গের মাপ প্রায় ১৮ ফুট। শিবলিঙ্গের প্রস্থের এই মাপই অন্য শিব মন্দিরের থেকে বর্ধমানেশ্বরকে আলাদা করে দিয়েছে। বর্ধমানেশ্বর তাই মোটা শিব নামেও পরিচিত।
মাঝে একটু সময় করে ঘুরে এলাম কৃষক সেতু। নির্জন দামোদরের ধারে সবুজ ঘাসে বেড়াতে মন্দ লাগবে না। যদিও রিকশাচালকদের বাঁধা সফর তালিকায় এই দিকটা থাকে না। কিন্তু আমি আগে বলে নিয়েছিলাম। কৃষক সেতুর আশপাশে খানিক সময় কাটাতে বেশ অন্যরকম লাগল। রিকশাচালকের তাড়ায় অবশ্য বেশিক্ষণ বসা গেল না। এই এক সমস্যা। আবার রিক্সা বা কোন যান বাহন না নিলেও একদিনে বর্ধমান দেখা সম্ভব নয়।
এরপর স্টেশনের উত্তর পশ্চিমের বর্ধমান গুসকরা রোডে নবাবহাটায় এসে পৌঁছলাম ১০৮ শিব মন্দির দেখব বলে। সারিবদ্ধ ভাবে বৃত্তাকার পদ্ধতিতে সাজানো রয়েছে এই মন্দিরগুলো। এখন প্রশাসনের তরফে মন্দির চত্বরে সৌন্দর্যায়ন হয়েছে।
এরপর গোলাপবাগ। গোলাপবাগ চত্বরে একসঙ্গে রয়েছে অনেক দ্রষ্টব্য স্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকটা অংশ গোলাপবাগে। এখানেই রয়েছে কুঞ্জ বিহার। জলাশয়ের মাঝে ছোট্ট দ্বীপের মধ্যে এই কুঞ্জ বিহারের শোভা অবশ্য দূর থেকেই দর্শন করতে হয়। নানা রঙের গোলাপের সমাহার চোখে পড়ল এখানে। এক নজরে দেখে নেওয়া গেল কৃষ্ণসায়রও। সায়রের জলে নৌবিহার খুবই আকর্ষণীয় হলেও সময়াভাবে তা এযাত্রায় আর সম্ভব হল না।
আলেকজান্ডারের কালের পার্থেনিসই হল আজকের বর্ধমান। আবার আইন-ই-আকবরি থেকে জানা যায় মোঘলদের সময় বর্ধমানের নাম ছিল শরিফাবাদ। নতুনগাং পিরবহরমে কুতুবউদ্দিন এবং শের আফগানের সমাধিস্থল সেই মোঘল আমলের কথা জানান দেয়। শহরের কোলাহলের পর শান্ত সেই মাজারে গেলে ভাল লাগে মন।
বিকেল গড়িয়ে এসেছে। এবার গন্তব্য শহরের মধ্যে রাজবাড়িতে। বর্ধমান রাজবাড়ির প্রায় গোটাটাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়। রাজবাড়ির একাংশে রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। যাদের ইতিহাসে আগ্রহ আছে তারা খানিকটা সময় কাটাতে পারেন এই সংগ্রহশালায়।
সারা দিন ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত। এবার পা বাড়ালাম কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সন্ধানে। যার টানে বর্ধমান আসা সেই সীতাভোগ এবং মিহিদানা টানছে আমায়। বর্ধমান শহর তো বটেই গোটা জেলা জুড়েই মেলে সীতাভোগ মিহিদানা। কিন্তু বর্ধমান শহরের হাতে গোনা কয়েকটি দোকানে মেলে আসল ঘিয়ে ভাজা সেই মিষ্টি। বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহিদানার ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯০৪ সালে বর্ধমানের রাজা বিজয়চন্দ মহাতাবকে রাজাধিরাজ উপাধি দেয় ইংরেজ সরকার। এই উপলক্ষ্যে বর্ধমান রাজপ্রাসাদে এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলার তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন বর্ধমান সফরে আসেন। সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট সব অতিথিরা। বড়লাটকে খুশি করার জন্য এবং অনুষ্ঠানকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বর্ধমানের রাজা বিজয়চন্দের নির্দেশে দুটি একদম নতুন মিষ্টি তৈরি হয় সীতাভোগ এবং মিহিদানা। শোনা যায় স্থানীয় হালুইকর ভৈরব চন্দ্র নাগ এই মিষ্টিদুটি তৈরির দায়িত্বে ছিলেন।
মিহিদানার প্রধান উপাদান চাল। মিহিদানা তৈরিতে সাধারণত গোবিন্দভোগ, কামিনীভোগ অথবা বাসমতী চাল ব্যবহার করা হয়। চাল গুঁড়ো করে তার সঙ্গে বেসন এবং জাফরান মেশানো হয়। তারপর জল মিশিয়ে সামান্য হলুদ রঙের একটি মিশ্রণ তৈরী করা হয়। একটি ছিদ্রযুক্ত পেতলের পাত্র থেকে ওই মিশ্রণ কড়াইতে ফুটন্ত গাওয়া ঘিতে বা ফেলা হয়। তারপর দানাগুলি কড়া করে ভেজে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তুলে চিনির রসে রাখা হয়। এখন অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গাওয়া ঘির বদলে ডালডা চলে এসেছে। তবে দাম দিলে খাঁটি জিনিস মেলে।
মিহিদানায় ছানার পরিবর্তে যেমন বেসন ব্যবহার হয় তেমন সীতাভোগে সাধারণত চালের গুড়ো ও ছানার মিশ্রণকে তেল বা ঘিয়ে ভেজে গরম রসে ভেজানো হয়। কেউ কেউ সাধারণ চাল গুড়োর জায়গায় সুগন্ধি আতপ চালের গুড়োও ব্যবহার করেন। সাধারণ সীতাভোগ মিহিদানা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি হলেও খাঁটি ঘিয়ে ভাজা অনন্য স্বাদের সীতাভোগ মিহিদানার কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
খাওয়া দাওয়া হল। এবার যাওয়ার পালা। বাড়ির জন্য সীতাভোগ মিহিদানা নিয়ে এবার পা বাড়ালাম ষ্টেশনের দিকে। এবার আর মেইন লাইন নয়, কর্ড লাইনের একটি বর্ধমান লোকাল পেয়ে ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়া গেল। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ট্রেন, ক্রমশ নজর থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে নবাবের শহর, রাজার শহর বর্ধমান।