ক্ষীরপাই-এর বাবরসা
পলাশ মুখোপাধ্যায়
কোথাও যাওয়ার সঙ্গে খাওয়ার একটা নিবিড় যোগ আছে৷ যে কোন রসিক মানুষই তা মানবেন৷ তাই আমাদের এই বিভাগে আমরা বেড়ানোর পাশাপাশি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী৷ রূপসী বাংলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে অপরূপ নানা জায়গা, সঙ্গে রয়েছে সেই এলাকার নাম করা অপূর্ব স্বাদের নানা খাবারও৷ আমাদের অনেকেরই হয়ত সেই মনোলোভা খাদ্যবস্তু বা নয়নাভিরাম সেই স্থানের নাম অগোচরে৷ ”যাওয়া মানেই খাওয়া” বিভাগে থাকছে এমনই কিছু জায়গার হদিশ৷ এই সংখ্যায় আমাদের গন্তব্য ক্ষীরপাই৷ নামে একটু ধন্দ লাগতেই পারে কিন্তু ক্ষীরপাইতে কোন ক্ষীরের মিষ্টি বিখ্যাত নয়। নোনতা এবং মিষ্টি মিশিয়ে এক দারুন খাবার বাবরসা-র লোভেই পাড়ি দেওয়া মেদিনীপুরের এই প্রাচীন সম্ভ্রান্ত জনপদে।
সাত সকালেই হাজির হাওড়া স্টেশনে। কর্মব্যস্ত হাওড়ায় তখন গিজগিজে ভিড়। তারই মাঝে একটা পাশকুড়া লোকাল যেন আমার জন্যই দাঁড়িয়েছিল। অফিস টাইমে উল্টোদিকের যাত্রা বলে জানালার ধারে দারুন একটা বসবার জায়গাও জুটে গেল। খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে টুকটাক মুখ চালাতে চালাতেই এসে গেল পাশকুড়া। ঘন্টাখানেকের পথ। এবার পাশকুড়া থেকে বাস ধরার পালা। স্টেশনের পাশের স্ট্যান্ড থেকে ছাড়ছে বাস। উঠে পড়লাম তারই একটায়। এখান থেকেও প্রায় এক ঘন্টার পথ। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই আমায় ক্ষীরপাই নামিয়ে দিল বাস।
মুঘল আমল থেকেই অনেক বিদ্রোহের সাক্ষী থেকেছে ঐতিহাসিক শহর ক্ষীরপাই। বর্তমানে আড়ে-বহরে বেড়েছে চন্দ্রকোনা ব্লকের সদর শহর। ক্ষীরপাই পুরসভাও প্রায় একশো চল্লিশ বছরের পুরনো। শহরের বাসিন্দাদের দাবি, ক্ষীরপাইয়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্যোগী হোক প্রশাসন।
শহরের নামকরণ নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। সংস্কৃতে ‘ক্ষীর’ শব্দের অর্থ অশ্বত্থ গাছ। তাই অনেকে মনে করেন এখানে দিগন্ত বিস্তৃত গোচারণভূমিতে সারি সারি অশ্বত্থ গাছ ছিল। সেখান থেকেই শহরের নামকরণ ক্ষীরপাই হয়ে থাকতে পারে। আবার ওড়িয়া ভাষায় ক্ষীরপাই শব্দের অর্থ গোচারণভূমি। জনশ্রুতি, ষোড়শ শতাব্দীতে শ্রী চৈতন্য শ্রীক্ষেত্র যাওয়ার সময় বেশ কিছুটা সময় এই এলাকায় কাটিয়েছিলেন। তিনি ভক্তদের ক্ষীরও বিতরণ করেন বলে কথিত রয়েছে। তারপর থেকে এই জনপদটি ক্ষীরপাই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ক্ষীরপাই শহরেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শ্বশুরবাড়ি। পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাছারিবাজারে ইশ্বরচন্দ্রের স্ত্রী দীনময়ীদেবীর বাপের বাড়ির বংশধরেরা আজও রয়েছেন। শহর থেকে মাত্র ছ কিলোমিটার দূরে বীরসিংহ গ্রাম। যে গ্রামে জন্মেছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। এত কাছে এসে সেই পূন্যভুমে যাব না তা কি হয়? তাই আগে পা বাড়ালাম সেখানেই। রয়েছে বিদ্যাসাগরের বাড়ি।
এক সময় ক্ষীরপাই শহরে তাঁত, রেশম-সহ একাধিক শিল্প গড়ে উঠেছিল। জনপদের প্রায় নব্বই শতাংশ বাসিন্দাই ওই সব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্যবসা ঘিরে শহরের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিও ঘটে। তৈরি হয় একাধিক বাজার। শিববাজার, কাছারিবাজার, দয়ালবাজার, তিলিবাজার, নুনিয়াবাজাকে কেন্দ্র করে পত্তন হয় একাধিক গঞ্জের।১৬৬০ সালে ফরাসি ও ইংরেজরা শহরের কাশীগঞ্জে বসবাস করতে শুরু করে। ক্ষীরপাইয়ে যখন বস্ত্র ব্যবসার রমরমা, তখনই ইংরেজদের দাপটে ফরাসিরা সব কারখানা তাদের হাতে তুলে দিয়ে দেশ ছাড়েন। স্থানীয়দের মুখ এই গল্প শুনতে শুনতেই চলে এলাম শহর ছাড়িয়ে কেথা নদীর ধারে। কেথা শিলাবতীর শাখা নদী। সামান্য দূর দিয়ে বয়ে গিয়েছে শিলাবতীও। ভারি চমৎকার নদীর ধারটি। ১১ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে নদীর ওপরে ছোট্ট সাঁকোটি আমার বেশ পছন্দ হল।
খানিক ক্ষণ এখানে থেকে এবার রওনা হলাম নীল কুঠির ধ্বংসাবশেষ দেখতে। কিন্তু প্রায় কিছুই দেখার নেই সেখানে। স্থানীয় মানুষজনের কথা মেনে সামান্য এগোতে মিলল শীতলাতলা। এই জায়গাটি দেখে মনটা ভরে গেল। ঠিক যেন তপোবন। গাছপালায় ছাওয়া, নদীর ধারে নির্জন মনোরম স্থান। রয়েছে শীতলা মায়ের মন্দির। যাদের দেবদ্বিজে ভক্তি আছে তাদের জন্য অতি উত্তম জায়গা। কিন্তু যাদের আমার মত ভগবানের সঙ্গে তেমন সখ্যতা নেই তাদেরও কিন্তু ভালো লাগবেই এই জায়গাটি।
এবার আবার শহরের পথে। যে জন্য ক্ষীরপাইতে আসা সেই বাবরসা দর্শনের পালা এবার। জানা যায়, ১৭৪০-১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় বর্গিরা ক্ষীরপাই শহর একাধিক বার আক্রমণ করে। বর্গিদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এলাকা ছাড়তে শুরু করেন বাসিন্দারা। সেই সময় এডওয়ার্ড বাবরশ নামে এক সাহেব বর্গিদের হঠিয়ে দেন। স্বস্তি ফেরে শহরে। এই ঘটনার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্থানীয় এক মিষ্টি ব্যবসায়ী ‘বাবরসা’ নামে একটি খাবার তৈরি করে এডওয়ার্ডকে উপহার দেন। সেই থেকেই শহরের মানুষের পছন্দের মিষ্টির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাবরসা।
আবার কারও কারও মতে এই মিষ্টি নাকি দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে সম্রাট বাবরকে খাওয়ানো হয়েছিল। সেই থেকেই এর নাম বাবরসা। তবে দ্বিতীয়টির তেমন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
মূলত ময়দা, দুধ, ঘি দিয়ে তৈরি হয় বাবরসা। তবে এখন এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে ঘিয়ের বদলে ডালডাতেই ভাজা হয় এই মিষ্টি। ছাঁচে ফেলে ভেজে রাখা হয়। এর পর খাওয়ার সময় তাতে রস ঢেলে পরিবেশন করা হয়। আগে অবশ্য মধুতে ডুবিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। দামও খুব বেশি নয় পাঁচ থেকে দশ টাকার মধ্যে।বাড়ির জন্য নিয়েই নিলাম বেশ খানিকটা।
কে প্রথম এই মিষ্টি বানিয়েছিলেন তার ঠিকঠাক হদিশ মেলা ভার। কথা হচ্ছিল কারিগর শঙ্কর সাহার সঙ্গে। শঙ্করবাবুর বাবাও বাবরসার কারিগর ছিলেন। বিশ্বাসের মিষ্টির দোকান এই অঞ্চলে পুরনো তারাও কিন্তু এব্যাপারে আলোকপাত করতে পারলেন না। তবে আশেপাশে প্রায় সব কটি মিষ্টির দোকানেই চোখে পড়ল সাজিয়ে রাখা বাবরসা।
১৭৭৩ সালে ক্ষীরপাই শহরে আচমকাই সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের ঢেউ আছড়ে পড়ে। পরবর্তীকালে ১৭৯৮-৯৯ সালে চুঁয়াড় বিদ্রোহের সূচনাও হয় এখান থেকেই। ১৮১৯ সালে ক্ষীরপাই বর্ধমান জেলা থেকে মেদিনীপুর জেলায় যুক্ত হয়। ক্ষীরপাইতে তৈরি হয় থানাও। এটিই বর্তমানে ক্ষীরপাই ফাঁড়ি। ১৮৪৫ সালে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ক্ষীরপাই হুগলি জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। হুগলি জেলায় চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর ও ক্ষীরপাই-তিনটি মহকুমা গড়ে উঠে। ১৮৭২ সালে ক্ষীরপাই মহকুমার নাম বদলে জাহানাবাদ( বর্তমানে আরামবাগ) হয়। পরে ফের ক্ষীরপাই মেদিনীপুর জেলায় যুক্ত হয়। ঘাটাল ও চন্দ্রকোনা নিয়ে তৈরি হয় ঘাটাল মহকুমা। ক্ষীরপাইয়ে দীনময়ীদেবী ছাড়াও সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরীর জন্মভিটে। ১৯৪৬ সালে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মন্ত্রিসভায় অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরী অর্থমন্ত্রীও হয়েছিলেন। শহরে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন মন্দিরও। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে উমাপতি শিব মন্দির তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে ক্ষীরপাই চন্দ্রকোনা ব্লকের সদর শহর। ১৮৭৪ সালে পুরসভা হিসাবে স্বীকৃতি পায় ক্ষীরপাই। রেল যোগাযোগ না থাকায় অসুবিধা হলেও সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। দিনভর ঘোরাঘুরি শেষে এবার ফেরার পালা। বিকেল বিকেল ফিরতে পারলে কলকাতায় ফেরার বেশ কয়েকটি বাস রয়েছে। সন্ধে হয়ে গেলে অবশ্য সেই পাশকুড়া হয়েই ফিরতে হবে। আমিও রওনা দিলাম কলকাতাগামী বাসেই। বাইরের অন্ধকারে দুরের গ্রামে জোনাকির মত আলো। ব্যাগে বাবরশা। ক্লান্তিতে বুজে এলে চোখ।