মোরব্বার মুলুকে

পলাশ মুখোপাধ্যায়

কোথাও যাওয়ার সঙ্গে খাওয়ার একটা নিবিড় যোগ আছে৷ যে কোন রসিক মানুষই তা মানবেন৷ তাই আমাদের এই বিভাগে আমরা বেড়ানোর পাশাপাশি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী৷ রূপসী বাংলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে অপরূপ নানা জায়গা, সঙ্গে রয়েছে সেই এলাকার নাম করা অপূর্ব স্বাদের নানা খাবারও৷ আমাদের অনেকেরই হয়ত সেই মনোলোভা খাদ্যবস্তু বা নয়নাভিরাম সেই স্থানের নাম অগোচরে৷ ”যাওয়া মানেই খাওয়া” বিভাগে থাকছে এমনই কিছু জায়গার হদিশ৷ এই সংখ্যায় আমাদের গন্তব্য মোরব্বার মুলুক ”সিউড়ি”৷

সে একটা সময় ছিল, যখন সিউড়ি যাওয়ার নাম শুনলেই আঁতকে উঠতেন সকলে। সরাসরি সিউড়ির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ বলতে ছিল একমাত্র ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। বীরভূমের জেলা সদর শহর হওয়া সত্ত্বেও তাই বোলপুর, রামপুরহাট নিদেন পক্ষে সাঁইথিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগের প্রতিযোগিতায় তেমন এঁটে উঠত না সিউড়ি। তবে সেই চিত্র এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গ পরিবহন নিগমের বাস চলাচল করছে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। ময়ূরাক্ষী ছাড়াও সিউড়ি থেকেই এখন দুটি ট্রেন যাতায়াত করে কলকাতায়। এছাড়া ভোর ভোর হাওড়া থেকে হুল এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। ঘন্টা পাঁচেক পর বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম সিউড়ি ষ্টেশনে।

পরিচিতদের কাছে আগেই শুনে নিয়েছিলাম সিউড়ির স্থান মাহাত্ম্য। তাই রিকশা নিয়ে সোজা চলে এলাম বাসস্ট্যান্ডে। বাসস্ট্যান্ড চত্বরে অসংখ্য খাবারের দোকান। রয়েছে মোরব্বার দোকানও। কিন্তু এখনই মোরব্বা নয়, আশেপাশে একটু ঘুরে দেখি। তাই সকালের জলখাবার খেয়ে রওনা দিলাম তিলপাড়া জলাধারের উদ্দেশে। শহর থেকে এই জলাধার খানিকটা দূরে, তাই রামপুরহাটগামী যে কোন বাস ধরে নিলে ভাল হয়। নামিয়ে দেবে একেবারে তিলপাড়া জলাধারের উপর। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সিউড়ি শহর ছাড়াতেই বাঁ দিকে দেখা মেলে এই সুবিশাল জলাধারের। কিছুটা এগোলেই দেখা যায় মূল জলাধারটিকে। ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে বয়ে আসা মযূরাক্ষী নদীর জল ম্যাসাঞ্জোরের পর এখানেই ধরে রাখা হয়েছে।

১৯৫১ সালের ২৯ জুন তিলপাড়া জলাধারটির উদ্বোধন হয়। জলধারণের ক্ষমতা এক সময় ৫ লাখ কিউসেক হলেও, এখন মজে যাওয়ার ফলে অনেকটাই কমে গিয়েছে। বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে জলাধারের কাছে পৌঁছলে সুবিশাল জলরাশির সৌন্দর্যে মন ভাল হয়ে যায়। মোরামের রাস্তা, দু’পাশ নানা গাছ। নানা রকমের পাখি, প্রজাপতি ও ফড়িংয়ের আস্তানা। মাছ শিকারি বকের সংখ্যাও এখানে প্রচুর। বাঁধের জলে ছোট ছোট জেলে ডিঙি এক দিক থেকে অন্যদিকে ভেসে বেড়ায়। শীত পড়তেই বিভিন্ন রকমের পরিযায়ী পাখি এখানকার জলে ডেরা বাঁধে কিছু দিনের জন্য। বিশাল বাঁধের উপরে পানকৌড়িরা রৌদ্রস্নানে ব্যস্ত থাকে সারা দিন। একটু হেঁটে রাস্তা পেরিয়ে জলাধারের অপর দিকটায় গেলে আরও ভালো লাগবে। ধুধু বালি ভরা নদীর মাঝে মাঝে রূপোলী ধারা।

ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে এবার ফেরার পালা সিউড়ি শহরে। ফের বাসে চেপে এলাম সিউড়িতেই। এবার গন্তব্য ১১৫ বছরের প্রাচীন গ্রন্থাগার “সিউড়ি রামরঞ্জন পৌরভবন স্বামী বিবেকানন্দ গ্রন্থাগার’’। সেখানে প্রবাসীর যাবতীয় পত্রিকার সংকলন থেকে শুরু করে বহু প্রাচীন গ্রন্থ সংগ্রহে রয়েছে। হেতমপুরের রাজার দানে তৈরি ওই গ্রন্থাগারে প্রায় লক্ষাধিক গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু পড়ার লোক এখন বড় কম। প্রাচীন এই গ্রন্থাগার ভবনটিও বেশ দেখবার মত।

এই ঘোরাঘুরিতেই দুপুর হয়ে গিয়েছে,এবার তো বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছে। রিকশা নিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ড। এখানে বেশ কয়েকটা ভালো হোটেল আছে। সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে হাঁটা দিলাম সোনাতোড় পাড়ার দিকে। বাসস্ট্যান্ডের পিছন দিকে সিউড়ির সোনাতোড় পাড়ায় ত্রান সমিতির কাছেই রয়েছে প্রাচীন দামোদর মন্দির। টেরাকোটার কাজের জন্য প্রখ্যাত মন্দিরটি। চারচালার এই মন্দিরটি বর্তমানে পুরাতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত ।

মোরব্বা শব্দটি এসেছে আরবী ‘মুরাব্বা’ থেকে। শোনা যায়, ১৭১৮ সালে রাজনগরের নবাব বদির উদ্জামাল লক্ষৌ, বেনারস ও আগ্রায় বেড়াতে গিয়ে প্রথম চালকুমড়োর মোরব্বা খান। সেই মোরব্বা খেয়ে তার এত ভাল লাগে যে সেখান থেকে কয়েকজন কারিগর নিয়ে আসেন এখানে। সেই কারিগর দিয়ে প্রথমে বেল, চালকুমড়া ও শতমূলের মোরব্বা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে পটল, গাজর, হরিতকি, আমলকী, পেপে,ন্যাসপাতি, আপেল প্রভৃতি নানা ফল ও সব্জির মোরব্বারও প্রচলন হয়।

সুমিষ্ট মোরব্বায় পুষ্টিগুণের সঙ্গে রয়েছে ওষধি গুণও। আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে মোরব্বার ব্যবহার রয়েছে। ছানার মিষ্টির চাইতে মোরব্বা থাকেও বেশি দিন। বাড়তি ‘প্রিজার্ভেটিভ’ ছাড়াই টিনের পাত্রে দিন পনেরো ভাল থাকে, ফ্রিজে রাখলে আরও বেশি। তাই অনেকেই যারা সিউড়ি বা এ চত্বরে আসেন তারা মোরব্বা কিনে নিয়ে যান এখান থেকে। সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডে তিন চারটি মোরব্বার দোকান রয়েছে। এদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ‘মোরব্বা’, ‘দাদুভাই’ প্রভৃতি দোকান। তবে এগুলির কোনটাতেই শুধুমাত্র মোরব্বা বিক্রি হয় না, সঙ্গে মিষ্টিও থাকে।

সিউড়ি শহরে মোরব্বা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের কাছে শুনছিলাম, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, রাজ্যের মন্ত্রি ,আমলা, যাদুকর, অভিনেতা, খেলোয়াড় থেকে সংস্কৃতি জগতের বহু স্বনামধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব সিউড়ির মোরব্বার স্বাদ গ্রহণ করেছেন এবং তৃপ্ত হয়েছেন। সিউড়িতে এসে মোরব্বা নিয়েও গিয়েছেন অনেকেই। সেই তালিকায় রয়েছেন সিনিয়ার ও জুনিয়ার পিসি সরকার, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, লালুপ্রসাদ যাদব, বহু প্রখ্যাত আমলা, অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমারের মতো বিশিষ্ট চলচিত্র অভিনেতার নাম। এমন কি উত্তমকুমারের জন্যও নাকি মোরব্বা গিয়েছে সিউড়ি থেকে।

তবে এটা ঠিক যে মোরব্বায় মিষ্টির পরিমান এত বেশি থাকে, তাতে একবারে বেশি খাওয়া সম্ভব নয়। আমিও তাই সামান্য মোরব্বা চেখে দেখে কিছুটা সঙ্গে নিয়ে পা বাড়ালাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। বিকেল গড়িয়ে এল, এবার ফেরার পালা। সিউড়ি নেমেই ফেরার টিকিট কেটে রাখায় জায়গা দখলের সমস্যাটা ছিল না। বিকেল নাগাদ ছেড়ে দিল বাস, জানালা দিয়ে দেখলাম মোরব্বার দোকানগুলিতে ইতিউতি জমছে ভিড়। ফুরফুরে হাওয়া, পথের দুপাশে সবুজের সংসার দেখতে দেখতে কখন যে বুজে এল চোখ কে জানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × five =