চমক আছে চম্পকনগরে

পলাশ মুখোপাধ্যায়

##

বাতাসে পুজোর গন্ধ ছড়াতেই ফের মন উচাটন। এমনিতেই আমার ঘরে মোটেই মন টেকে না। কয়েক সপ্তাহ কোথাও না গেলেই পেটের মধ্যে, মনের মধ্যে কেমন যেন গুলবুল করে। নাহ্‌ সেদিন সকালে উঠে মেঘলা মেঘলা একটা আবহাওয়া দেখে বিদ্রোহ করে উঠল মন। বাড়ি এবং অফিসের বসকে ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়লাম ঝোলা কাঁধে নিয়ে। মোটামুটি ভাবনায় ছিল গন্তব্যস্থল। এবারে আর ট্রেন নয়, ধরলাম বাস। এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেট থেকে দুর্গাপুর গামী একটি বাসে উঠে পড়লাম সকাল সাতটা নাগাদ। গন্তব্য পানাগড়। ধর্মতলা থেকেও বাসে আসা যায়। এছাড়াও প্রচুর ট্রেন হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে আসছে পানাগড়ে।

ঘন্টা আড়াইয়ের পথ। বাস কন্ডাক্টরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি অবশ্য নেমে গেলাম বুদবুদ বাইপাসের মোড়ে। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে না করতেই এসে গেল আর একটা বাস। এই বাস যাবে কসবা নামে একটি গ্রামে। আমার প্রথম গন্তব্য কসবার গা ঘেঁষা গ্রাম চম্পকনগর। প্রায় আধ ঘন্টার এই বাস যাত্রাটি কিন্তু বেশ সুন্দর। গ্রামের মধ্যে দিয়ে পিচ ঢালা পথ। পাশ দিয়ে চলেছে দামোদরের ক্যানাল। ভালোই লাগছিল।

কসবায় নেমে পদব্রজে রওনা দিলাম চম্পক নগরের দিকে। খুব ছোট্ট গ্রাম। লাল মাটির পথের দুধারে কাশের মেলা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শীর্ণকায়া গাঙ্গুর নদী। এই বেলা বলে রাখি আমরা কিন্তু হাজির চাঁদ সদাগরের স্মৃতিমাখা সেই চম্পকনগরে। এখানকার পরতে পরতে জড়িয়ে মনসা মঙ্গলের স্মৃতি চিহ্ন। হাঁটতে হাঁটতে প্রথমেই দর্শন পেলাম শিব মন্দিরের।


চাঁদ সদাগর ছিলেন শিবের উপাসক। তার একনিষ্ঠ শিব ভক্তির ফল ভুগতে হয়েছিল তাঁকে। সে গল্প আমাদের কম বেশি সকলেরই জানা। স্থানীয়দের মতে এই শিব মন্দিরে থাকা পাথরের শিব লিঙ্গটি স্বয়ং চাঁদ সদাগর স্থাপন করেছিলেন। পরে এই মন্দিরেই তিনি শিবের উপাসনা করতেন।

ভক্তি বা পুরাণ বাদ দিলেও কিন্তু মন্দির চত্বরটি বেশ মনোরম। একটা ছোট্ট টিলার পরে মন্দিরটির পরিবেশ খুব ভাল। বিশাল একটা বটগাছের ছায়ায় মোড়া গোটা মন্দিরটি। পাশে সবুজ মাঠ। শান্ত মন্দির চত্বরে দুদণ্ড বসে থাকতেও মন্দ লাগে না।

মন্দিরের বাইরে বটের ছায়ায় বসে গল্প জুড়েছিলাম স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে। তাদের সকলেরই বিশ্বাস এই অঞ্চল পুরোটাই একসময় ছিল চাঁদ সদাগরের তালুক। মনসার অভিশাপে বানিজ্য তরি ডুবে যাওয়ার পর চাঁদ এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। লখিন্দরের জন্মও নাকি এখানেই।

শিব মন্দির দেখে পা বাড়ালাম সামান্য দূরে থাকা বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘরের দিকে। হ্যা, এই সেই বাসর যেখানে মনসার হুকুমে কালনাগিনী এসে দংশেছিল লখিন্দরকে। এখানেও একটি উঁচু টিলার পরে রয়েছে এই বাসর ঘরের ধ্বংসাবশেষ।

প্রাচীন ইটের তৈরি এই ধ্বংসাবশেষ আদৌ সেই বাসরের কিনা এ নিয়ে যুক্তি তক্কো চলতেই পারে। তবে স্থানীয়দের বিশ্বাসে তা এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি। তবে কি, দুই গ্রামের মাঝে এই ফাঁকা জায়গাটা বেশ সুন্দর হওয়াতে শীতকালে প্রচুর মানুষ এখানে ভিড় জমান চড়ুইভাতিতে। পুরানের আবহে দিনভর হইচই আনন্দে কাটান সকলে। আমারও কিন্তু নির্জন শান্ত এই এলাকা বেশ ভালই লাগল।

পুরান-ভক্তি-ধর্ম ছেড়ে এবার যাব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনে। এই এলাকা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রণডিহা। দামোদরের তীরে আরও একটি শান্ত সবুজ এলাকা। রণডিহাতে দামোদরের ওপরে ছোট্ট ব্যারেজ বানিয়েছে ডিভিসি। দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে আসা জলধারাকে আটকাতে চেক ড্যাম করা হয়েছে।

দামোদরের সৌন্দর্য উপভোগ করার সবচেয়ে আদর্শ জায়গা রণডিহা। চড়ুইভাতির ব্যবস্থা রয়েছে। শীতকালে অনেকেই আসেন এই অঞ্চলে দামোদরের ধারে চড়ুইভাতি করতে। ব্যারেজের পর নদীর ধার ঘেঁসে সবুজের বিস্তার। চাইলে হেঁটে পার হয়ে ওপারের গ্রাম থেকেও ঘুরে আসা যায়।

শান্ত জলে নৌবিহার এখানকার একটা বড় আকর্ষণ। চাইলে জেলেদের সঙ্গে নৌকায় চড়ে দামোদরে বুকে ঘুরে বেড়ানো যায়। আমিও সেই লোভ সামলাতে পারিনি, দর-দাম করে ঘন্টা খানেক নৌবিহারের মজা নিলাম তারিয়ে তারিয়ে। খাওয়ার ব্যাবস্থা রণডিহাতে আছে। দুপুরে ছোটখাটো একটা হোটেলে ভাত মাছের ঝোল দিয়ে দিব্যি ভোজন সারা গেল। এখানে সেচ দফতরের একটা বাংলোও আছে। আগে থেকে সেই বাংলো বুকিং করে নিলে রাতে থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যায়।

রণডিহা থেকে ফিরব কিন্তু পানাগড়ের দিকে। বিকেল বিকেল উঠে পড়লাম একটা ট্রেকারে। বাসও চলে কিন্তু আমি মাঝপথে ভরতপুরে একটু নামব যে। ভরতপুরে ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত একটি বৌদ্ধস্তূপ রয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় খননকার্য চালিয়ে এই স্তুপটি খুঁজে বের করে।

আমাদের এই কচি সফরে পুরান বা ধর্ম হয়েছে, হয়েছে প্রকৃতির রূপ দর্শনও। ইতিহাসই বা বাদ থাকে কেন? সেই অভাব অনেকটাই পূরণ করে দেবে এই বৌদ্ধ স্তুপ। পুরাতত্ত্বে বা প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহ থাকলে এখান থেকে ঘুরে আসা যেতেই পারে। ফাঁকা সবুজ ঘাসে মোড়া এই জায়গাটিও মন ভাল করে দেবে।

এবার ফেরার পালা। পানাগড় ভরতপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার। পানাগড়ে এলে কলকাতায় ফেরার ট্রেন বা বাস দুইই মিলবে সহজে। সামান্য এগোলে দুর্গাপুর, সেখানে চলে গেলে তো কথাই নেই। আমি অবশ্য একটা কলকাতা গামী বাসেই উঠে পড়লাম। বাইরের আলো কমে এসেছে অনেকটাই, প্রায়ান্ধকার বাসে বসে চোখ বুজে এল আপনা আপনিই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × four =