লালপাহাড়ির দেশে যা

উজ্জ্বল গরাই

কী একটা মন কেমনের আনন্দে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চাঁদ দেখে দেখে কীসের যেন আলাপ চলছিল বৃষ্টির।
– কীরে ঘুমোসনি এখনো, শুয়ে পড় কাল তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
মায়ের ডাক পেয়ে হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল। সেই কোন ছোট্টবেলায় গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এসেছে। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। তার একান্তের জানালা খুললে এখনো যেন সকালের শিউলি বাতাস চুপি চুপি তার চুল ছুঁয়ে যায়। আঁকাবাঁকা ধুলো – দূর্বার পথ, ঝোপের আড়ালে এক টুকরো নীল ছড়ানো অপরাজিতা, বিকেলের খোলা আকাশে হলুদ পাখির গান, কাশঘেরা ছোট এক প্রিয় নদী, আর সদা প্রসন্ন মানুষের মুখ…. সব তার বড় ভালো লাগে।
তার জেদের কারণেই কালকে সপরিবারে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় যাত্রা।
সকাল সকাল journey শুরু। সঙ্গে মা বাবা আর বোন রিনি।
রাত জাগলেও খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙেছিল বৃষ্টির। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে জানালার কাছের সিটে বসে পড়ল।
লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে হঠাৎ মাঝপথে এসে গাড়ি খারাপ। ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও ঠিক করতে পারল না। বৃষ্টির বাবা ফোনটা বের করতেই দেখলেন টাওয়ার নেই। মহা মুশকিল। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। এদিকে বিকেল গড়িয়ে পড়ল।
– বাবু এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে একটা শহর আছে। আমি বরং একবার খোঁজ নিয়ে আসি…. দেখি যদি কোনো মেকানিক পাই। আপনারা গাড়িতেই থাকুন। এই বলে ড্রাইভার বেরিয়ে পড়ল ।
জায়গাটা বেশ নির্জন। একটা একটানা কোকিলের মিষ্টি ডাক ভেসে আসছিল খুব কাছ থেকেই। বৃষ্টি কান পেতে উন্মনা হয়ে তাই শুনছিল দাঁড়িয়ে। রিনি পাশের পলাশ গাছ থেকে ফুল তোলার চেষ্টা করছিল। তার বাবা এসে ছোট্ট একটা ডাল হাতে দিয়ে বলল – পলাশ ফুল! এর মধু খেতে দারুণ মিষ্টি।
সত্যিই তো ….দেখ কত মিষ্টি !
রিনি আনন্দিত হয়ে দিদিকে ডাকতে লাগল ।
বৃষ্টি ফিরে তাকিয়ে বলল – কই দেখি ।
তারপর ফুলের ডাল ধরে টানতে লাগল ।
– মাথার চুলটাতে গুঁজে দ্যাখ কেনে দারুণ মানাবেক !
হঠাৎ এই নির্জনে মানুষের আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল বৃষ্টি ।
গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। বেশ সবল এবং মোটাসোটা। সবমিলিয়ে মানুষটি বড় অদ্ভূত!
এমন নির্জন স্থানে মানুষটিকে দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। রিনি তো এক ছুটে মায়ের কাছে। বৃষ্টির বাবা হালকা সাহস করে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
– নাই নাই ভয় কুরতে হবেক নাই। হামি চোর ডাকাত লই।
বিশ্বাস করার সাহস হল না কারো। লোকটি এবার হেসে উঠল। সে বড় অদ্ভূত রকমের হাসি।
– তুরা শহর থাক্যে আসেছিস লয়।
বৃষ্টির বাবা বলে উঠল – হ্যাঁ। আমারা অযোধ্যা পাহাড় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল।
বৃষ্টি এতক্ষণে বলে উঠল – তুমি কে?
– হামার নাম সুরেন টুডু। ইখানেই হামার ঘর।
– তোমার হাতে ওটা কী?
– বাঁশী।
– বাঁশী! হ্যাঁ তাই হবে। কোকিলের ডাকের সাথে বাঁশীর ওই মিষ্টি সুরেই তাহলে বাজতে ছিল এতক্ষণ।
– তুদের ডেরাইভার আইসতে আইসতে ত ঢের রাইত হঁয়ে যাবেক। তাছাড়া রাতের বেলায় ইখানে থাকা খারাপ। ইকটু ধূরেই হামদের ঘর, যদি বিশ্বাস হয় তবে আজকের রাতট উখানেই রইতে পারিস। ভয় নাই। ঘরে হামি আর হামার মা থাকে। একটা ঘরে মা শুয়ে আর একটা ঘর ফাঁকাই থাকে।
বৃষ্টি বলে উঠল – তুমি?
লোকটি হেসে উঠল। সেই অদ্ভূত হাসি!
– হামি আইগনাটায় গাছতলে শুই।
একটু একটু যেন এবার বিশ্বাস জন্মাল। রাস্তার থেকে পাঁচ মিনিট দূরেই একটি মাটির ঘর। বেশ পরিচ্ছন্ন আশপাশের জায়গাগুলো। দুয়ারের মাঝখানে একটি আমগাছ… চারপাশে বেদি করা। সেখানে গিয়ে সবাই বসল। রিনির যেন তখনো ভয় কাটেনি ।
– কোনো ভয় নেই মা, ওরা তো আমাদের মতোই।
– ইখানটতে তোরা বইস… হামি ইক্ষুনি আসছি। এ কথা বলে সে পাশের ঘর থেকে একটি লন্ঠন নিয়ে এসে রাখল। এক বৃদ্ধা একটি বড় পাতায় করে কিছু খেজুর গুড়ের পিঠা নিয়ে এল।
– বাবুরা তোরা কুথা থিকে আসছিস?
– কলকাতা।
– কুইলকাত্তা! সে তো অনেক ধূর!
বাবুরা গরীব মানুষ, কিছু নাই। এই পিঠা কতেক খাও। বেটা হামার খেজুর গুড়ের পিঠা খাইত্যে বড় ভালোবাসে।
আঃ সত্যিই যেন মাটির মমতা মাখা অপূর্ব স্বাদ পিঠেগুলোর ।
রিনি এতক্ষণে চেঁচিয়ে উঠল – আমি আরো একটা নেব।
মা তাকে মৃদু ধমক দিল। বৃষ্টি তার পিঠেটা বোনকে দিতে চাইলে বৃদ্ধা বলে উঠল। খাও মা তুমি খাও। ইখনো ঢের পিঠা আছে ।
বৃষ্টির যেন সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল ।
লন্ঠনের আলো, তালাইয়ের বিছানা – অনেক আগে তার দাদুর মুখে শুনেছিল সে। মাটির গন্ধে উদ্বেল এক স্বপ্নাচ্ছন্ন রাত। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল তার। পূর্ণিমার চাঁদ তখন মাঝ আকাশে। কানে বেজে উঠল একটা মধুর সুর। অতি সন্তর্পণে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। দেখল আমগাছটার তলায় সেই অদ্ভূত লোকটি একাকী বাঁশী বাজিয়ে চলেছে মিষ্টি সুরে ……
লালপাহাড়ির দেশে যা
রাঙা মাটির দেশে যা
ইতাক তোকে মানাইছেনাই রে
এক্কেবারে মানানছেনাই রে
এতক্ষণে ডায়েরিটার কথা মনে পড়ল তার। সহসা চমকে উঠল…. কে যেন ডাকছে – বৃষ্টি ওঠ , ঘুমোসনা আর, আমরা পৌঁছে গেছি।
চেতন ফিরল বৃষ্টির। গাড়ি থেকে নেমে এল। লাল পলাশের রক্তিমতায় সাজানো অপরূপ অযোধ্যা পাহাড়। তবে কী…. সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে এল। মনে হল একটা বাঁশীর আওয়াজ যেন বামনী জলধারার কুলু কুলু রবে মিলিয়ে যাচ্ছে।
লালপাহাড়ির দেশে যা
রাঙামাটির দেশে যা ……
পাশের পলাশ গাছ থেকে একটি পলাশ ফুল তুলে খোঁপায় গুঁজে নিয়ে হেসে উঠল বৃষ্টি। সে হাসি যেন মৃদু বাঁশীর সুরের সঙ্গে বনপলাশের বুকে মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে ……

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − 7 =