জয়ী

দিব্যায়ন সরকার, মেখলিগঞ্জ, কোচবিহার

ছোটবেলা থেকে নাচটার প্রতি একটা আলাদা টান ছিল কবিতার। পড়াশুনা, ছবি আঁকা সব কিছু শিখলেও ভারতনাট্যম তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। শহরের কোন বড় অনুষ্ঠান হোক কিংবা কলেজের যে কোন ফাংশান – তার ডাক আসবেই। ছাত্র যুব উৎসবে তিন তিন বার রাজ্য সেরা সে। সেবার কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ফেয়ারওয়েল প্রোগ্রামে সূর্যবন্দনা নৃত্যটি কবিতার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কলেজের এ.জি.এস সন্দীপের খুড়তোতো দাদা অনুপ সেদিন কলেজ এসেছিল। কবিতার সৌন্দর্যের সাথে অনবদ্য নৃত্যকৌশল – অনুপের ভালবাসা প্রথম ঠিকানা পায়। বিয়ের প্রস্তাবটা অনুপের বাড়ি থেকে আসে। বাবার এক ছেলে, পোস্ট অফিসে ক্লার্কের চাকরি – এসব দেখে আর না করেননি কবিতার বাবা। শুধু একটা অনুরোধ তিনি রেখেছিলেন যে মেয়ে যেন তার বিয়ের পরেও নৃত্যের চর্চা করতে পারে। সানন্দে সেই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল অনুপের পরিবার। যেন ষোলো কলা পূর্ণ ।
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে চলেছে কবিতা। কাঁদতে কাঁদতে দু চোখ ফুলে ঢোল। এতগুলো লোকের সামনে অপমানিত, লজ্জিত হতে হল তাকে – কি দোষ ছিল তার! শাশুড়ি মা তার নাচটাকে পূর্ণ সমর্থন করলেও শ্বশুরমশাই ঠিক পছন্দ করতেন না, তবে কোনদিন কিছু বলেননি। অনুপদের পাড়ার দুর্গা পুজো বিরাট করে হয় আর দশমীর অনুষ্ঠান আরও জব্বর। অনুপ কবিতাকে নাচের প্রস্তাব দেয়। প্রথম দিকে লজ্জায় না করলেও শেষমেশ অনুপের জোরাজুরিতে রাজি হয়। অনুষ্ঠানের দিন দেখতে দেখতে চলে এলো। ‘অনেক বড় বড় ব্যাক্তিবর্গ থাকবেন, সঙ্গে শ্বশুরমশাই ও শাশুড়িমা প্রথমবার তার নাচ স্টেজে দেখবে’ – এটা ভেবেই আনন্দ এবং ভয় মিশ্রিত একটা জম্পেশ অনুভুতি হচ্ছিল কবিতার। আদ্যাস্তোত্রের উপর কত্থক ও ভারতনাট্যম মিলিয়ে এক অপূর্ব নৃত্য পরিবেশন করে। নাচ শেষের পর হাততালির বন্যা বয়ে যায়। উপস্থিত সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ – ‘এত সুন্দর নৃত্য আগে কখনো দেখিনি’ বলে অনেকে মন্তব্য করেন। শ্বশুর মশাইয়ের বেশ লেগেছিল, যদিও মুখে কিছু বলেননি তিনি।
পরের দিন বিজয়া করতে কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেরা বাড়িতে এসেছেন। কবিতার নাচের প্রশংসা করেই স্বভাবের দোষে নিন্দার সুত্রপাত ঘটালেন। সকালে যখন তারা বাজার করে ফিরছিলেন তখন নাকি পাড়ার কিছু বখাটে ছেলেরা আড্ডায় কবিতার নামে কটূক্তি করেছে, তাকে নাকি ‘মাল’ বলে সম্বোধন করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শুনে রাগে – ক্ষোভে ফেটে পড়ল কবিতার শ্বশুরমশাই। সবার সামনেই কবিতাকে চিৎকার করে বলেন – বাড়ির সন্মান ধুলোয় মিশিয়ে তাদের মত এত ঐতিহ্যশালী বনেদী বাড়িতে নাচ – গান করা একদম চলবে না। এসব করলে তাকে বাড়ির বাইরে গিয়ে করতে হবে।
আচ্ছা, ওই বখাটে ছেলেগুলোর কথায় অপমানটা কার বেশি হয়েছিল? স্বনামধন্য নিমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, কয়েকটা অশিক্ষিত, ছোটলোকের কথা তাদের এত গায়ে লেগে গেল! সবাই যতই বড় বড় ‘আধুনিকতা’র বুলি কপচাক, সত্যি সত্যি সেটা কেউ পারেনি এখনও। দু’চোখ মুছে উঠে বসে কবিতা । এর প্রতিকার তাকে করতে হবে। তবে সময় বুঝে।

দীর্ঘ একুশ বছর পর। ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়ির ব্যালকনির রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল কবিতা। অপেক্ষা করছিল অনুর জন্য, অনুপ্রিয়া, তার মেয়ে কখন আসবে? বাড়ির প্রথম বংশধরের নামে তার মায়ের নামের ছায়া টুকুও পড়তে দেয়নি তার বাড়ির লোক। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! শেষ পর্যন্ত মায়ের মনের গড়নটাই পেল মেয়ে, নাচের প্রতি তার আসক্তি। ছোট থেকেই চোখে পড়ার মত। প্রমাদ গুনেছিল কবিতা, তাই আর দেরী না করে ছোটবেলাতেই ঐ ‘ঐতিহ্যশালী বনেদি’ পরিবার থেকে সরিয়ে এনেছিল তাকে। ফলাফল তার চোখের সামনে।

অনুপ ফোন করেছিল একটু আগে। কত্থক নৃত্যে রাজ্য প্রথম হয়ে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়েছে অনু। শুনে আনন্দে আত্মহারা কবিতা। এই দিনটার জন্য এতদিন থেকে অপেক্ষা করছিল সে। লজ্জায়, ঘেন্নায় এবং সর্বোপরি অপমানে সে যে স্বপ্ন ত্যাগ করেছিল, তাই আজ দু’হাত ভরে একমুঠো রোদ ছড়াতে ছড়াতে নিয়ে এসেছে অনু।

কলিং বেল বাজাতেই মাকে দরজা খুলতে দেখল অনু। কিন্তু মাকে দেখে থমকালো একটু। মায়ের মুখে হাসি, চোখে জল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 − four =