কারখানা

নির্মল ঘরামি, বলাগড়, হুগলি ##

আপনি যদি বর্তমানে চোখ-কান খোলা রেখে চলাচল করার মানুষ হন এবং আপনার চারিদিকের প্রত্যক্ষ করা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার অভিপ্রায় থাকে,তাহলে বাইরে বের হলে কত সব ঘটনা দেখবেন এবং শুনবেন যা আপনাকে ভাবাবে এবং গভীরে নিয়ে যাবে। আপনি যত ভাববেন,তত‌ই উতলা হয়ে উঠবেন—কোনো সমাধান সূত্র আপনি খুঁজে পাবেন না।যত খোঁজার চেষ্টা করবেন,তত‌ই দেখবেন আপনি আরো গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে যাচ্ছেন। আপনার আশেপাশের কোলাহল জগৎ তখন আপনার কাছে কেমন নীরব ঠেকবে। আপনার চারপাশে ঘিরে থাকা লোকজন ভাববে , লোকটা দিন দিন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে—আত্মভোলা মানুষের মতো।

         একদিন আপনার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণে আপনাকে যেতেই হবে মান-সম্মান রক্ষার্থে।যাওয়ার সময় আপনারা জনা চারেক সহকর্মী একসাথে অফিস থেকে যাবেন। আপনার সহকর্মীদের মধ্যে একজন খুব মজাদার এবং রসিক মানুষ। তিনি আপনাদের নানান মজার গল্প শুনিয়ে যাবে আর আপনারা তার  গল্প শুনে খিলখিল করে না হেসে থাকতে পারবেন না।

        একঘন্টা ধরে আপনাদের ট্রেন যাত্রা করতে হবে। আপনাদের রসিক বন্ধুটিও একসময় তার হাসির খোরাক খুঁজে না পেয়ে সেও নীরব হয়ে যাবে। তখন আপনার সহকর্মীরা চলন্ত গাড়ির মৃদু-মন্দ ঝাঁকুনিতে  হাল্কা তন্দ্রাচ্ছন্ন  হয়ে পড়বে।আপনি তখন জানলার ফাঁক দিয়ে আপনমনে তাকিয়ে শেষ ফাগুনের সন্ধ্যাগমনের প্রাক্ মুহূর্তের হাল্কা তমসাচ্ছন্ন প্রকৃতিকে উপভোগ করবেন।

          হঠাৎ একটা স্টেশন থেকে জনা কয়েক পড়ুয়া ট্রেনে উঠবে, যাদের মধ্যে দুটি মেয়েও আছে। তাদের কথাবার্তা আপনার কানে আসতেই‌ আপনি অবাক হয়ে ভাববেন বর্তমান যুগটা কতো পাল্টে গেছে। মনে হবে সময়ের স্রোতস্বিনী কতো পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে সভ্যতার দ্বীপটিকে।

           সহসা দুই মহিলার কথোপকথন আপনার কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে।তাদের কথোপকথন আপনি মনোযোগ সহকারে শুনবেন।একসময় আপনার কানে আসবে প্রথম ভদ্রমহিলা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ানোর কথা।পরীক্ষার সময় একটি ছেলে ব‌ই খুলে লিখছিল।উনি ব‌ইটা নিয়ে নিলে তাকে ছেলেটার কাছ থেকে শুনতে হয়ে ছিল যে,সে একগাদা টাকা দিয়েছে ডিগ্ৰিটা পাওয়ার জন্য এবং তার সঙ্গে অনেক অশ্লীল কথাও। সেইদিনই তিনি রিজাইন দিয়ে চলে আসেন।

          দেখতে দেখতে  একসময়ের গন্তব্যস্থল এসে পড়বে।আপনারা ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে দেখবেন আপনি জায়গাটাকে যে রকম ভেবেছিলেন তার ঠিক বিপরীত। আপনার মতো বড়ো শহর না হলেও খুব একটা কম যায় না। ভাববেন পঞ্চায়েত এলাকাও এখন কতো উন্নত। আপনার ভাবনার জগৎ পরিবর্তন হয়ে যাবে। তারপর সেখান থেকে একটা টোটো ধরে বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে যাবেন।

            লজে পৌঁছে কিছুক্ষণ পাখার তলায় বসে  বিশ্রাম নেবেন। একসময় উঠে পড়তে হবে আপনাদের আনা গিফ্টটা মেয়ের হাতে তুলে দেবার জন্য। এরপর সকলে মিলে একটু গল্পগুজব করবেন আর ‌আপনাদের হাসানো সহকর্মীর মজার মজার কথায় মাঝে মধ্যে হেসে উঠবেন।ঘন্টা খানেক পরে আপনারা খেতে বসবেন।বেশ ভালো ভালো খাবার খেয়ে একসময় উঠে পড়তে হবে। ফেরার পথে আপনি একা হয়ে যাবেন বলে খাওয়া দাওয়ার পর আপনি দেরি করতে চাইবেন না। তাড়াতাড়ি সহকর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসার জন্য প্রস্তুত হবেন এবং লজ্ থেকে বাইরে এসেই  আবার একটা টোটো ধরে স্টেশনে চলে আসবেন। এসে শুনতে পাবেন আপনার ট্রেন আসতে এখনো আধ ঘন্টা বাকি। অগত্যা একটা শেডের তলায় গিয়ে বসবেন।রাত তখন সাড়ে আটটা পার হয়ে গেছে। একজনের কাছে জিজ্ঞেস করে আপনি জানতে পারবেন আপনার ট্রেনের সময় ন’টা বেজে তিন মিনিটে হলেও আসতে আসতে প্রায় ন’টা পনের-কুড়ি।

         আপনি বসে বসে কিছু সময়ের জন্য আনমনা হয়ে যাবেন। অনেক ভাবনা আপনার মাথায় এসে ভীড় করবে আর মগ্ন হয়ে সে সব ভাববেন। হঠাৎ আপনার কানে আসবে বর্তমান রাজনীতির আলোচনা যা নিয়ে দু’জন লোক,যতসম্ভব বন্ধু হবে, একজন কেন্দ্র সরকারের পক্ষে এবং অপর জন রাজ্য সরকারের পক্ষে তুমুল বিতর্ক লাগিয়েছে আপনার পিছন দিকে।বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে পরিবেশটা।যখন প্রায় দু’জনের তর্ক চরমে পৌঁছবে, তখন তৃতীয় ব্যক্তি ওদের থামিয়ে বলবে, ‘তোরা এই একটা ফালতু জিনিস নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলি।বর্তমানে রাজনীতি বলে কিছু নেই,সব দুর্নীতিতে ভরা। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পোশাকগুলো শুধু আলাদা; কিন্তু চরিত্রগুলো সব এক। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের এইসব আলোচনা করাই উচিত নয়।’

            আপনি মনোযোগ সহকারে ভদ্রলোকটির কথা শুনে ভাববেন, আপনি যখন রাজনীতি করতেন,তখন মানুষ নেতাদের মান্য করতেন; কিন্তু এখন তাদের দেখলে অকথ্য ভাষার একটা বিশেষণ  তাদের নামের পাশে বসিয়ে দেয়। আপনার মনে তখন আপনার সময়ের নেতাদের কথা স্মরণের প্রেক্ষাপটে অবলোকন করবেন। আপনিও যে তখন রাজনীতি করতেন সেই চিত্রগুলিও আপনার কল্পনার ইজেলে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠবে।

     ‌ ‌        একসময় তারা কখন আপনার পিছন থেকে উঠে গেছে, আপনি টের‌ও পাবেন না। ন’টা বাজতে তখন‌ও পাঁচ মিনিট বাকি। একবার ট্রেন কোথায় আছে তার ঘোষণা শুনবেন। সঙ্গে সঙ্গে আপনার ডানদিকে কিছুটা দূরে বসে থাকা অল্প বৃদ্ধ একটি লোক বলে উঠবে,’এখন‌ও আসতে পনের মিনিট লাগবে।’লোকটাকে দেখে আপনি ভেবে ঠিক করতে পারবেন না,সে পাগল না সাধারণ মানুষ। ঠিক তখনই তার মুখে শুনবেন,’দাদা দু’টো টাকা দেবেন, একটু কিছু খেতাম।’আপনি অবাক হয়ে যতক্ষণ ভাবতে থাকবেন এই লোকটা ভিক্ষা চাওয়ার উপযুক্ত কিনা, ততক্ষণে আপনার হাতটা পকেটে চলে যাবে দু’টো টাকা খোঁজার জন্য আপনার এবং টাকা দু’টো তার হাতে দিয়ে একসময় জিজ্ঞাস করে জানতে পারবেন তার ছেলে তাকে খেতে দেয় না। তার স্ত্রী মারা গেছে বছর দুই হয়েছে। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার করেছিলেন, চাকরি পেয়ে বাইরে চলে যায়। সেখানে সেখানকার মেয়ে বিয়ে করে ওখানেই থেকে যায়।যে ছোট্ট জায়গাটা ছিল তাও সরকারের পোষ্যপুত্র মানে এলাকার এক ‘দাদা’ অল্প কিছু পয়সা দিয়ে একপ্রকার জোর করেই কিনে নেয়। একটা ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।স্ত্রীর কাজকর্ম করতে গিয়ে আর‌ নিজেদের দু’টো পেট চালাতে গিয়ে সে  পয়সাও একদিন শেষ হয়ে যায়।তাই এখন…

        আপনি দেখবেন লোকটি চোখ মুছছে। আপনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করারও সাহস পাবেন না; বরং আরো দশটা টাকা দিয়ে কিছু খেয়ে আসতে বলবেন।লোকটিও কিছু না বলে উঠে যাবে।

     ‌     আপনি আবার এযুগের ছেলেদের মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে ভাবতে বসবেনএবং তার সঙ্গে এযুগের বাবা-মায়েরা আজকের ছেলেদের এই পরিনতির জন্য যে কম দায়ী নয়,এটাও আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে। আপনি ভাববেন,তারা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে লালিত-পালিত‌ ও বর্ধিত হয় এবং বহু অর্থের বিনিময়ে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আজকের শিক্ষিত পোশাকী বাবু হয়ে ওঠে। এরপর গাদা গাদা অর্থ ব্যয় করে কোনো একটা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে কোনভাবে ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সমতুল্য বিষয়ে পাশ করে একটা চাকরি পেয়ে তারাও তাদের বাবা-মায়ের মতো এক‌ইরকম আচরণ করে। গভীর হয়ে এসব ভাবতে গিয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন।

           ঠিক তখনই একটা ছেলের গলায় আপনি অকথ্য ভাষায় ফোনে কথা বলতে শুনবেন। আপনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবেন একটি যুবক উদ্ভ্রান্তের মতো এদক-ওদিক ঘুরছে আর কথা বলছে। আপনার ছেলেটিকে দেখে মনে হবে ওকে কিছু বলবেন কিনা ততক্ষণে ছেলেটি আপনার বাঁ দিকের কিছুটা দূরে একটা সিটে বসে পড়েছে। ছেলেটার মুখ থেকে আপনি যে শেষ কথাটা শুনবেন, সেটা আপনাকে আরো বিস্ময়ে হতবাক করে দেবে,’শোন্,আর তিন-চার বছর দেখবো, তারপর কিছু না পেলে,রেললাইন তো আছেই!’আপনি ছেলেটিকে কাছে ডেকে এসব কথা বলার কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই ‌ছেলেটি জায়গা ছেড়ে উঠে চলে যাবে।

             ঠিক তখনই ট্রেন ঢোকার ঘোষণা শুনতে পাবেন। ধড়ফর করে উঠে পড়ে সঠিক জায়গায় গিয়ে ট্রেনে উঠবার জন্য দাঁড়াবেন। ট্রেনে উঠে একটা জায়গাও পেয়ে যাবেন। দু’একজন সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে একসময় আপনার গন্তব্য স্টেশন এসে গেলে আপনি নেমে পড়ে একটা অটো ধরে বাড়ি পৌঁছে যাবেন।

           পরদিন থেকে আবার আপনার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা শুরু হবে। কাজের চাপে সব কথা ভুলেও যাবেন। যে সহকর্মীর মেয়ের বিয়েতে আপনি গিয়েছিলেন সে দিন পনেরো পরে আপনাকে জানাবে ওর এক প্রতিবেশী বন্ধুর সাতাশ বছরের যুবক চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আপনি কারণটা জানতে চাওয়ার আগেই সে বলব,’একটা প্রাইভেট কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কোনো চাকরি পাচ্ছে না বলে বহুদিন হতাশায় ভুগছিলো।দিশা খুঁজে না পেয়ে শেষে এই পথ বেছে নিলো!’

        আপনি নির্বাক হয়ে যাবেন। গভীর ভাবনায় নিমগ্ৰ হয়ে মানসচক্ষে অবলোকন করবেন প্রতিষ্ঠানের পর প্রতিষ্ঠান।আর সেগুলো থেকে বছরের পর বছর উৎপাদিত হচ্ছে বেকারের পর বেকার। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসবে কোনো এক অজানা বেদনায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × one =