বাঙালির গান (পর্ব ৩) মঙ্গলকাব্য:

পার্থসারথী সরকার ##

আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গসাহিত্যে যে ধর্মমূলক আখ্যানের প্রচলন ছিল, তাকেই সাধারণভাবে মঙ্গলকাব্য হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। লৌকিক এবং বহিরাগত ধর্মের এমন অপূর্ব সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে ইতীপূর্বে দেখা যায় নি। তুর্কী আক্রমণে বিপর্যস্ত বাংলার জনগণ যে নতুনভাবে সমাজকে চিনল, সেখানে স্বপ্নভঙ্গ, মোহভঙ্গের ছবি তো ছিলই। এতদিনের পরিচিত দেবতারা আর স্বর্গের মাধুরী দিয়ে সুরভিত করতে পারল না সাধারণের জীবনকে। স্বাভাবিক কারণে পুরাণ পরিবর্তিত হল। স্বর্গের দেবতারা সমাজে নিত্যকর্ম সাধনের জন্য মানুষের রূপে নেমে এলেন। বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী পাল রাজারা বঙ্গের শাসনকর্তা হ’লে, মহাযান বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে লৌকিক ধর্ম সংস্কারের এক সংমিশ্রণে ঘটে এবং এক মিশ্র লৌকিক ধর্মমতের প্রচলন ঘটে বঙ্গদেশে। পুরাতন পৌরাণিক কাহিনিগুলি লৌকিক আখ্যায়িকার মধ্যে দিয়ে নিজেদেরকে প্রকাশ করল পরিপুষ্টি ঘটালো। শুধু তাই নয় কাহিনিগুলো এমন হয়ে উঠল যে যেখানে পুরাণের ব্যতিক্রম ঘটল সেখানেই মঙ্গলকাব্যগুলো সার্থক হয়ে উঠল। মূলত পুরাণ থেকে প্রেরণা নিয়ে জন্ম হলেও সংস্কৃত পুরাণের প্রতি এদের কোন অটুট নিষ্ঠা থাকল না। এই কাহিনিগুলির একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল যে এই কাহিনিগুলির মধ্যে বাস্তবজীবনের চিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটে উঠেছে। যদিও আঙ্গিকগত দিক থেকে এই কাহিনিগুলি সংস্কৃত কাব্যের কাছেই আংশিক ঋণী।

       হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সংঘর্ষেই মঙ্গলকাব্যগুলির সৃষ্টি। এই কাব্যগুলি সংস্কৃত পুরাণ, ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষ মানব মাহাত্ম্যমূলক, ক্রমে এর মধ্যে অলৌকিকতার প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে মঙ্গলকাব্য অলৌকিকতা বর্জিত মানবিক কাহিনি। রাষ্ট্রপোষিত মুসলমান ধর্মের সামনে অসহায় সাধারণ মানুষ মঙ্গলকাব্যের মৌলিক ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষ কাহিনির মধ্যে অলৌকিক দেবশক্তির পরিকল্পনা ক’রে সমস্ত দুখঃদশাকে তাঁর ইচ্ছা ভেবে সান্ত্বনা পেয়েছে। মঙ্গলকাব্যগুলির সঙ্গে বাংলার ব্রতকথার কয়েক স্থানে নৈকট্য আছে। “ব্রতকথা বাংলার লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অঙ্গ। মঙ্গলকাব্যের মত ব্রতকথারও উদ্দেশ্য লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন, ব্রতকথা হইতেই যে মঙ্গলকাব্যের প্রেরণা আসিয়াছে, তাহা অতি সহজেই বুঝিতে পারা যায়।” মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে বর্ণনার প্রত্যক্ষতা দেখতে পাওয়া যায়। আসলে মঙ্গলকাব্যের কবিগণ সাধারণ মানুষের জীবনিকে সামনে রেখে তাঁদের কাব্য রচনা করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকা-কাব্য মাত্রই ‘পাঁচালি’ নামে পরিচিত ছিল; মঙ্গলকাব্যও স্থানে স্থানে ‘পাঁচালি’ নামে উল্লিখিত হয়েছে। মঙ্গলকাব্য মূলত পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে লেখা। আবেগমূলক কাব্যের অংশগুলি পয়ারে গ্রথিত, এছাড়াও লঘু ত্রিপদীও ব্যবহৃত হয়েছে। মানবমনের সহজাত রসানুভূতিগুলি মঙ্গলকাব্যের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই।

       মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায়, মঙ্গলকাব্যগুলি কয়েকটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বহন ক’রে চলেছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে প্রথমেই গণেশাদি পঞ্চদেবতার বর্ণনা, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ, সৃষ্টির রহস্য-বর্ণনা, মনুর প্রজাসৃষ্টি, প্রজাপতির শিবহীব যজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, উমার তপস্যা, মদনভস্ম, রতিবিলাপ, গৌরীর বিবাহ, হরগৌরীর কোন্দল, পার্বতী-চণ্ডী-শিবের সম্পর্ক, দেবগণের বরপ্রাপ্ত মানব-মানবীর মর্ত্যে পূজাপ্রচার, স্বর্গে প্রত্যাবর্তন, বারোমাসী, নারীগণের পতিনিন্দা, নায়কের চৌতিশা স্তব প্রভৃতি দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন পাকপ্রণালীর বর্ণনা, বিবাহবাসরের বর্ণনা ইত্যাদিও মঙ্গলকাব্যগুলির বর্ণনীয় বিষয়। মঙ্গলকাব্যে বিবাহ-বাসরে ধাঁধা জিজ্ঞাসা এবং তার উত্তরদানও দেখা যায়।

       মঙ্গলকাব্যগুলির শ্রেণিবিভাগ করলে দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে মূলত তিনধরণের মঙ্গলকাব্য আছে। এগুলি হল– ১) বৈষ্ণব, ২) পৌরাণিক ও ৩) লৌকিক। নিম্নে একটি তালিকার সাহায্যে তাঁদের বিভাগ দেখানো হল—

১) বৈষ্ণব—চৈতন্যমঙ্গল, অদ্বৈতমঙ্গল, গোবিন্দমঙ্গল, কৃষ্ণমঙ্গল, রাধিকামঙ্গল, জগত্ঙ্গল, কিশোরিমঙ্গল, স্মরণমঙ্গল, গোকুলমঙ্গল, রসিকমঙ্গল, জগন্নাথমঙ্গল ইত্যাদি।

২) পৌরাণিক—গৌরীমঙ্গল, ভবানীমঙ্গল, দুর্গামঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কমলামঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, চণ্ডিকামঙ্গল ইত্যাদি।

৩) লৌকিক—মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, কালিকামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, রায়মঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল ইত্যাদি।

মঙ্গলকাব্যের উৎপত্তি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের সংগীতের মধ্যে ‘মঙ্গল রাগ’ নামে একটি রাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেকের মতে এই রাগেই ঐ কাব্যগুলির আদ্যোপান্ত গাওয়া হ’ত বা ঐ কাব্যগুলির গায়নকালে মূল রাগ হিসাবে এই রাগ পরিগণিত হত, তাই এগুলি ‘মঙ্গলগান’ নামে পরিচিত হত। পদাবলীও মঙ্গলরাগে গীত হত। পাঁচালির উপর পৌরাণিক মঙ্গলরাগের প্রভাববশতই এগুলি মঙ্গলগীতি নামে পরিচিত হতে পারে। আবার কেউ কেউ একে মঙ্গলাসুর-নিধনের কাহিনির সঙ্গে জুড়ে মঙ্গলকাব্যের নামকরণ করতে চান। অনেকে এক মঙ্গলবার থেকে শুরু করে অন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত এই অষ্ট দিবসের পাঠের ভিত্তিতে এই নামকরণ বলে মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন যে, এই গীত শ্রবণে শ্রোতার গায়কের মঙ্গল হয়, তাই এই কাব্যের এমন নামকরণ।

       ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’র আনুমানিক সময়কাল হল খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী। এই ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ রচনাকালেই মঙ্গলকাব্য (চণ্ডীমঙ্গল) যে একটি নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেছিল, তা তাতে উল্লিখিত শ্লোকের বুঝতে পারা যায়। যেমন, এই শ্লোকটিতে ‘চণ্ডীমঙ্গলে’র ‘আখেটিক খণ্ড’ ও ‘বনিক খণ্ডে’র বীজ আছে—‘ত্বাং কালকেতু-বরদাস্থল গোধিকাসি/ যা ত্বং শুভা মঙ্গলচণ্ডিকা।/ শ্রীশালবাহন স্থপাদ্‌ সসূনো বুভুজে/ রক্ষোহস্যুজে করিবাং গ্রমতী বসন্তী।।’ মঙ্গলকাব্যের কবিদের অনুসন্ধনে ময়ুরভট্ট নামে একজন কবির উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও তাঁর কাব্য সম্বন্ধে কোন পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায় না। মাণিক দত্তকে তাই অনেকে মঙ্গলকাব্যের আদি কবি হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। বাঙালির কয়েক শতকের জীবনের সঙ্গে এই মঙ্গলকাব্যগুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত চলেছিল মঙ্গল কাব্যের কাল। অবশ্য এর পরবর্তী ক্ষেত্রেও বেশ কিছু মঙ্গলকাব্য লেখা হয়েছিল, তবে তখন সে যুগের অবসান ঘটেছে—চলেছে পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতক থেকে খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এই ছয়শত বৎসর যে মঙ্গলকাব্যের যুগ চলেছিল সে যুগকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—১) উদ্ভব যুগ, ২) সৃজন যুগ এবং ৩) ঐশ্বর্য যুগ। উদ্ভব যুগ (Age of origin) মুলত খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতককেই বোঝায়।উদ্ভব যুগে মূলত সংস্কৃত পুরাণে দেবদেবী অন্বেষণের সূচনা হয়। সৃজন যুগ (Age of origin) বলতে মূলত পঞ্চদশ –ষোড়শ শতককেই বোঝায়। ঐশ্বর্য যুগ (Age of glory) খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতককে  বোঝায়। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে ব্যাপকভাবে মঙ্গলকাব্য আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। মঙ্গলকাব্যগুলি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. রমেশচন্দ্র মজুমদার একে ‘they are first original poems in Bengali, apart from songs and translations’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

মনসামঙ্গল কাব্য:

মঙ্গলকাব্য বাংলা, আসাম ও  বিহারের কিয়দংশে বেশি  প্রচলিত। ভারতবর্ষে বৈদিক যুগ থেকেই সর্পপূজা প্রচলিত ছিল, ভারতের অস্ট্রিক গোষ্ঠীর থেকে দ্রাবিড় গোষ্ঠীতে যা বেশি পরিলক্ষিত হয়। ঋক্‌বেদে বর্ণিত ‘অহির্বুধ্ন’র উল্লেখ আছে। যজুর্বেদেও সর্পের শ্রদ্ধাপূর্ণ উল্লেখ আছে। ‘মহাভারতে’ বাসুলি কাহিনি, জরৎকারু কাহিনির  উল্লেখ আছে।  আলেকজান্ডারের সেনানীদের বৃত্তান্তেও তা পাওয়া যায়। গ্রীক সর্পমস্তা  ‘মেডুসা’র সঙ্গে মনসার মিল পাওয়া যায়। তান্ত্রিক বৌদ্ধ-ব্রতাদিতে সর্প অধিষ্ঠাত্রী ‘কুরুকুল্লা’ ও ‘জাঙ্গুলি’র উল্লেখ পাওয়া যায়।  প্রাচীন যুগে সর্পচিকিৎসক ‘জাঙ্গুলিক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।  বিপ্রদাসের ‘মনসাবিজয়ে’ও জাগুলি নামটির উল্লেখ আছে। দক্ষিণ ভারতে নাগম্মা সুদামা সর্প দেব-দেবীর পূজা এখনও প্রচলিত। ‘মনসামঙ্গলে’র কাহিনিতে ব্রতকথা, ব্যালাড ও মহাকাব্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে। ‘মনসামঙ্গলে’র চম্পকনগর ভাগলপুর সংলগ্ন এলাকা অনেকে বলেছেন।  মঙ্গলকাব্যের জাতি-কুল বিচার করে অঞ্চলভেদে তাদের চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন ডক্টর সুকুমার সেন যথা রাঢ়ের মনসামঙ্গল, রচয়িতা বিষ্ণু দাস, ক্ষেমানন্দ, সীতারামদাস, রসিক মিশ্র, বাণেশ্বর রায় প্রমুখ। পূর্ববঙ্গের পদ্মাপুরাণ রচয়িতা নারায়ণ দেব, বিজয় গুপ্ত, দ্বিজ বংশীদাস, ষষ্ঠীবর প্রমুখ।  উত্তরবঙ্গ কামতা-কামরূপের মনসামঙ্গল কাব্য রচয়িতা তন্ত্র বিভূতি, জগজ্জীবন ঘোষাল, মানকর, দুর্গাবর, জীবনকৃষ্ণ মৈত্র প্রমুখ।  বিহারী মনসামঙ্গল– তেমন কোন কবির উল্লেখ পাওয়া যায় না।  দক্ষিণ ভারতের অম্ববরু  নাম্নী গ্রাম্য সপ্প দেবীর গল্পে পাওয়া যায় যার সঙ্গে মঙ্গলকাব্যের মনসার বহু মিল আছে।  খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে ষোড়শ শতকের সমাপ্তি-কাল পর্যন্ত যে সমস্ত মনসামঙ্গলের কবি ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—কানা হরিদত্ত, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, নারায়ণ দেব,  গঙ্গাদাস সেন প্রমুখ। প্যারীমোহন দাশগুপ্ত-কর্তৃক বরিশাল থেকে প্রাপ্ত ১৩০৮ সালে বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’ পুঁথিতে-‘মুর্খে রচিল গীত না জানে মাহাত্ম্য/ প্রথমে রচিল গীত কানা হরিদত্ত’ একথা দিয়ে কানা হরিদত্ত কে চিহ্নিত করা হয়েছে।  দীনেশচন্দ্র ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের মধ্যে হরিদত্তের  ভনিতাযুক্ত ‘পদ্মার সর্পসজ্জা’র দৃষ্টান্ত  দিয়েছেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার  সম্ভবত এটি পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার দীঘাপইৎ গ্রাম থেকে উদ্ধার করেছিলেন। সংশয়হেতু তাঁকে ‘মনসামঙ্গলে’র আদি কবি রূপে অনেকে গণনা করেন না। পূর্ববঙ্গের সর্বাপেক্ষা প্রচলিত কবি বিজয় গুপ্ত। বেশি অনুলিপির ফলে আসলের অতি অল্পই রক্ষিত হয়েছে। বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্যারীমোহন দাশগুপ্তের উদ্যোগে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’ প্রকাশিত হয়।  বিজয় গুপ্ত বরিশালের গৈলা গ্রামে (প্রাচীন নাম ফুল্লশ্রী)  জন্মগ্রহণ করেন। বিজয় গুপ্তের কাব্য অনুসরণ করলে জানা যায়, ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে হুসেনশাহ গৌড়ের সুলতান হবার  বছর খানেকের মধ্যেই বিজয় গুপ্ত কাব্যটি রচনা করেন। কবির ভনিতার এর প্রমাণ রয়েছে—‘ঋতু শশী বেদ শশী পরিমিত শক।/ সুলতান হুসেন শাহ নৃপতি তিলক।।’ অর্থাৎ ১৪১৬ শকাব্দে বা ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে হুসেন শাহের রাজত্বকালে কাব্যটি লেখা হয়। জ্যোতিষ বিচারে ১৪১৬ শকে কাব্য রচনা কাল হিসেবে গৃহীত হতে পারে। বিজয় গুপ্তের পিতা ছিলেন সনাতন এবং মাতা রুক্মিণী। তাঁর কাব্যের ভাষা নানা লিপিকরদের হাতে প’ড়ে পরিবর্তিত হয়েছে।  কাব্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও তার গ্রন্থনে দুর্বলতা আছে। ছড়া ও ব্যালাডের সমন্বয়ে সৃষ্ট এই কাব্যের মধ্যে ‘বেহুলার কীর্তন গানে’র উল্লেখ আছে। চৈতন্যপূর্ব বঙ্গে কীর্তন-গানের তেমন কোন প্রচলিত রূপ ছিল না  বলেই অনেকে এই উল্লেখ প্রক্ষিপ্ত ব’লে মনে করেন।  কাহিনিতে বৈচিত্র্য না থাকলেও এ কাব্যের স্বচ্ছ বর্ণনাভঙ্গি কথকথা ও  পাঁচালির রীতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কাব্য-ধারাতে বিজয়গুপ্তের কাহিনী এখনো ‘রয়াণি’ বা রজনী হিসেবে গীত হয়। চব্বিশ পরগণার বাদুড়িয়া মতান্তরে নাদুড়্যা বটগ্রাম গ্রামে বিপ্রদাস পিপিলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কাব্যে স্পষ্ট  রচনা কালের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে। এই কাব্যের ভনিতায় পাই—‘সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ/ সুলতান হুসেন শাহ নৃপতি প্রধান’। অর্থাৎ কাব্যটি লেখা হয় সুলতান হুসেনশাহের রাজত্বকালে ১৪১৭ শকে, বা ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে। তখন বাংলায় হোসেন শাহী রাজত্বকাল। কবির পিতা মুকুন্দ পণ্ডিত। কাব্যটি ব্যালাড ধরণের।  তার কাব্যটির মধ্যে চরিত্র-চিত্রণের যথার্থতা লক্ষণীয়। চরিত্রচিত্রণে আধুনিকতার পরিচয়ও মেলে। মনসামঙ্গলের অন্যতম প্রধান কবি নারায়ণদেব। তাঁর পূর্বপুরুষের নিবাস রাঢ়দেশ, সেখান থেকে তাঁরা চলে যান ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার একটি গ্রামে।  পিতামহ উদ্ধারণদেব, মাতা রক্ষিণী। কায়স্থকুলে কবির জন্ম। তাঁর মঙ্গলকাব্য বহুল গীত হতো, তার প্রমাণ মেলে কাব্যের মধ্যে, যেখানে বহু গায়েন, লিপিকর বা কবির ভূমিকা আছে।  তাঁকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে স্থাপন করা যায়। সংস্কৃতজ্ঞ নারায়ণদেবের কাব্যে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের প্রভাব আছে। তিনি বৈষ্ণবানুকূল ছিলেন। তাঁর কাব্যের বহুস্থলেই ও ধুয়াতে বৈষ্ণব পদাবলীর ঝংকার পাওয়া যায়। 

       সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত মঙ্গলকাব্যগুলি পূর্ব যুগের মত গৌরববাহী না হ’লেও স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করেছে।  এই যুগের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের মধ্যে একটি শিষ্ট কাব্যরূপ হলো ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’ বা ‘বাইশা’। এতে বাইশজন না হলেও বহু কবির রচনা পালা-অনুসারে গ্রথিত (দ্রষ্টব্য-আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’)। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে পূর্ববঙ্গে মনসার পূজা খুবই প্রচলিত ছিল।  এখানে বিশেষ-বিশেষ কবির রচনার বিশেষ-বিশেষ অংশ একত্রে সংকলিত ক’রে এক ধরনের ‘মনসামঙ্গল’ তৈরি করা হতো।  ষট্‌কবির ‘মনসামঙ্গলে’রও প্রচলন ছিল।  ষট্‌কবির ‘মনসামঙ্গলে’র পুঁথি না পাওয়া গেলেও বাইশার অনেক পুঁথি পাওয়া গেছে।  এই ‘মনসামঙ্গলে’র কবিরা হলেন বিশ্বেশ্বর, অকিঞ্চন দাস, রঘুদাস দ্বিজ, রমাকান্ত, জগন্নাথ বিপ্র, বংশীদাস দ্বিজ, সীতাপতি, রাধাকৃষ্ণ, বল্লভ ঘোষ, নারায়ণদেব, গোপীচন্দ্র, জানকীনাথ, কমলনয়ন, যদুনাথ, বলরাম, হরিদাস ভট্ট, রামনিধি, অনূপচন্দ্র ভট্ট, রামচন্দ্র, মহিদাস, দ্বিজ হরিদাস প্রভৃতি। সাহিত্যগত উৎকর্ষের দিক থেকে যদিও এর তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। মনসা মঙ্গলকাব্যের কবি দ্বিজ বংশীদাসের পিতা ছিলেন যাদবানন্দ এবং মাতা ছিলেন অঞ্জনা। ময়মনসিংহের এই কবির ‘পদ্মাপুরাণ’ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।  তিনি সংস্কৃত ভাষা পুরাণ ও দর্শনে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।  তাঁর কাব্যের গল্পে কিঞ্চিৎ বৈচিত্র্য আছে।  শাক্ত-দেবীর বর্ণনা করলেও তাঁর কাব্যে সর্বপ্লাবী বৈষ্ণব ভাবধারা প্রভাব বিস্তার করেছিল। দক্ষিণ রাঢ়ের সেলিমাবাদের সরকারের শাসনকর্তা বারা খাঁর অধীনে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের পিতা শংকর বৃত্তিভোগী ছিলেন।  এই কাব্যের কাব্যরচনার নির্দেশ দেওয়া আছে।  তাঁর কাব্য বৈচিত্র্যহীন, তথাপি স্থানে স্থানে যে ভৌগোলিক বিষয়গুলির যথাযথ অনুসরণ আছে। কাব্যের স্থানে-স্থানে মুকুন্দের অনুকরণও স্পষ্ট।  তন্ত্রবিভূতির ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কাহিনীতে সামান্য কিছু নতুনত্ব আছে।  উত্তরবঙ্গের মঙ্গলকাব্য ধারায় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যে দেখতে পাওয়া যায়।  জগজ্জীবন ঘোষালের পূর্বে সপ্তদশ শতকের প্রথমে তাঁর কাব্য রচিত হয়।  জগজ্জীবন ঘোষাল তৎকালীন দিনাজপুরের কুচিয়ামোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর কাব্যে তন্ত্রবিভূতির অনুসরণ আছে। সাধারণ বর্ণনা ও দক্ষতা থাকলেও আদি রসের বর্ণনা বর্জনীয় ছিল।  সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যান্য ‘মনসামঙ্গল’ কবিদের মধ্যে বিষ্ণু পাল, ষষ্ঠীবর দত্ত, কালিদাস, সীতারাম দাসেরা উল্লেখযোগ্য। এইসব কাব্যের কোনো-কোনো পদাংশ গীতিধর্মী।

 চন্ডীমঙ্গল কাব্য:

 প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকেই সৃষ্টির মধ্যে একটি শক্তিময়ী নারী শক্তির পরিকল্পনা সমাজে ও সাধনা তে গৃহীত হয়েছিল। ভারতীয় সধনাতেও স্ত্রীদেবতার বিশেষ প্রভাব আছে।  বেদে বাক্‌-সুক্ত, রাত্রি-সুক্ত, ভুবনেশ্বরী দেবীর মন্ত্র আছে।  কেনোপনিষদে’ আছে  উমা হৈমবতীর আখ্যান। ‘সাংখ্যায়ণ-গুহ্যসূত্রে’ ভদ্রকালী,  হিরণ্যকেশী গুহ্যসূত্রে’  ভবানী দেবী, শুক্লযজুর্বেদে’র বাকসেনীয়  অম্বিকা, তৈত্তরীয় আরণ্যকে’  রুদ্রের পত্নী ইত্যাদি উল্লেখ থেকে নারীদেবতার কল্পনা যে আর্য সমাজের ছিল তা অস্বীকার করা যায় না।  বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও কল্পনার সাক্ষাৎ মেলে।  হিন্দুর দশমহাবিদ্যা আসলে বৌদ্ধ দশ দেবী। ‘মহাভারতে’ দেবীশক্তির উল্লেখ আছে।  মার্কন্ডেয় পুরাণে’ চণ্ডীর পরিচয় পাওয়া যায়।  এছাড়াও ‘স্কন্দ পুরাণ’, ‘দেবীপুরাণ’, কালিকাপুরাণ’ ইত্যাদিতেও চণ্ডীর উল্লেখ মেলে।   চন্ডী শব্দটি দ্রাবিড় ভাষার ‘চান্ডী’ শব্দজাত।  চন্ডীমঙ্গলে মঙ্গলচন্ডীর ব্রত কথার প্রভাব লক্ষণীয়। 

       মানিক দত্ত চন্ডীমঙ্গলের অন্যতম প্রাচীন কবি।  মুকুন্দ তাঁর কাব্যে মাণিক দত্তের উল্লেখ করে এ কথা স্বীকার করেছেন ‘মাণিক দত্তের দাণ্ডা করিয়ে প্রকাশ’।  তিনি সম্ভবত মালদহের ফুলবাড়ী গ্রামে  (ফুলুলা নগর) জন্মগ্রহণ করেন।  সৃষ্টিপালা বাদ দিলে তাঁর কাব্য কোন দিক দিয়েই উল্লেখযোগ্য নয়।  মূল কাব্যটি খুব সম্ভবত ব্রতকথা-জাতীয় ছিল।  পুঁথির ভাষায় অর্বাচীনতা আছে। অনুমেয়, কবি শিক্ষায় অধিক দূর অগ্রসর হতে পারেননি। সম্ভবত ‘মঙ্গলচন্ডীর গীত’ গেয়েই তিনি জীবিকানির্বাহ করতেন এবং সঙ্গে দোহার ও বাজাদার রাখতেন। দ্বিজ মাধবের  কাব্যটি চন্ডীমঙ্গল নামে অভিহিত হয়ে থাকে।  কবি হুগলী জেলার ত্রিবেণীর কাছে সপ্তগ্রামে  জন্মগ্রহণ করেন।  পিতা ছিলেন পরাশর।  কাব্যের পুঁথির সন নির্দেশ অনুযায়ী তিনি মুকুন্দের পূর্বে ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি রচনা করেন।  কাহিনিটি  অনেকটা ব্রতকথার ঢঙে রচিত—যেখানে কাব্যের কাহিনি আনুপূর্বিক সংরক্ষিত হলেও তা যথার্থ কাব্যে উন্নীত হতে পারেনি। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ রচয়িতা কবিকঙ্কন মুকুন্দের আদি নিবাস ছিল বর্ধমানের রত্না নদীর তীরস্থ দামুন্যা গ্রামে।  পিতামহ জগন্নাথ মিশ্র শিবের উপাসক হলেও বৈষ্ণবমতে বিশ্বাসী ছিলেন।  কবি দামুন্যা ছেড়ে মেদিনীপুরের (তৎকালীন ওড়িশা) জমিদার বাঁকুড়া রায়ের সভায় উপনীত হন এবং তাঁর পুত্র রঘুনাথ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। কাব্য-অনুযায়ী তাঁর গ্রন্থের রচনাকাল আনুমানিক ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে।  তাঁরও ভনিতায় আছে ‘শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গণিতা/ হেনকালে দিলা গীত হরের বনিতা’। অর্থাৎ ১৪৯৯ শকে, বা ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটির সূত্রপাত। মুকুন্দ বাস্তবধর্মী কবি ছিলেন।  এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে দ্বিজ জনার্দনের ‘চন্ডীমঙ্গল’,  বলরাম কবিকঙ্কণের ‘চন্ডীমঙ্গল’,  দ্বিজ মাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’,  গোবিন্দদাসের ‘কালিকামঙ্গল’ ইত্যাদি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।

        ষোড়শ শতক চন্ডীমঙ্গলের উৎকর্ষের যুগ।  সপ্তদশ শতকের কাব্য গুলিতে গুণগত উৎকর্ষের ঘাটতি আছে।  এই শতকের একমাত্র উল্লেখযোগ্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য হলো রামদেবের ‘অভয়ামঙ্গল’।  তার কাব্যে বৈষ্ণব ভক্তিরস আছে।  স্থানে স্থানে করুণরসও স্থান পেয়েছে।  এছাড়াও অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মধ্যে দ্বিজ কমললোচনের ‘চন্ডিকাবিজয়’, ভবানীপ্রসাদ রায়ের ‘দুর্গামঙ্গল’,  রূপরামের ‘দুর্গামঙ্গল’ উল্লেখযোগ্য। কৃষ্ণ রামদাস বেশ কয়েকটি মঙ্গলকাব্য রচনা করেছিলেন যথা—‘কালিকামঙ্গল’, ‘রায়মঙ্গল’, ‘ষষ্ঠীমঙ্গল’, ‘শীতলামঙ্গল’ ‘কমলামঙ্গল’

শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্যের কবি হিসেবে সপ্তদশ শতাব্দীতে দুজন বিশিষ্ট কবির উল্লেখ মেলে।  এরা হলেন শংকর কবিচন্দ্র এবং রামকৃষ্ণ রায়। শংকরের সমগ্র পুঁথি মেলে নি, শুধু ‘শঙ্খপরা’ এবং ‘মাছধরা’ শীর্ষক পালা দুটি পাওয়া গেছে। কাব্য গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট; তথাপি কবির ভাষার ঔজ্জ্বল্য ও তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করার মতো।  রামকৃষ্ণের নিবাস ছিল হাওড়া জেলার রসপুর গ্রাম।  তার কাব্যকে শিবমঙ্গল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।  সংস্কৃতজ্ঞ কবির কাব্যে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভবম্‌’ কাব্যের প্রভাব আছে। দ্বিজ রামেশ্বরের ‘শিবায়ন’-এই ধারার শ্রেষ্ঠ রচনা যা ‘ভব-ভাব্য’।

       ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের দেবতা ধর্মের উৎপত্তি সম্বন্ধে মতভেদ আছে।  একাংশের মতে তিনি বৌদ্ধ দেবতা এবং একাংশের মতে, ধর্মদেবকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে গেলে আরো পিছিয়ে বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে পৌঁছাতে হবে।  বৈদিক সূর্য ও বরুণের এঁর সঙ্গে সাদৃশ্য আছে।  বৈদিক দেবতার সঙ্গে হরিশচন্দ্রের কাহিনী সাদৃশ্য আছে।  ধর্ম বাঁকুড়ায় ‘বাঁকুড়া রায়’,  শ্যামবাজারে  ‘কালু রায়’,  গোপালপুরে ‘কাঁকড়া বিছে’ নামে পরিচিত।  তিনি নিরাকার হলেও অনেক ক্ষেত্রে তাঁর সাকার মুক্তির সন্ধান মেলে। এই রূপ কূর্ম শিলার প্রথমদিকে ডোম-সমাজে এঁর পূজা প্রচলিত থাকলেও পরবর্তীতে  সর্বত্র স্বীকৃত হয়েছে।  ডোম ছাড়াও জেলে, নাপিত, যোগী, বাগদি, সদ্‌গোপ, ধোপা, ময়রারাও এঁর পূজায় বিশেষ অংশ গ্রহণ করেন। সমগ্র ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে দুটি কাহিনী দেখতে পাওয়া যায়—রাজা হরিশচন্দ্রের গল্প এবং লাউসেনের গল্প।  সম্ভবত হরিশচন্দ্রের গল্পটি আদি।  পরবর্তীতে লাউসেনের বীরত্বকে নিয়ে দ্বিতীয় কাহিনীটি রচিত হয়েছে।  রামাই পন্ডিতকে ধর্মমঙ্গলের কবিতার আদি প্রবর্তক ব’লে মনে করেন অনেকেই।  রামাই পন্ডিতের ভনিতাযুক্ত দুটি পুঁথি পাওয়া যায় ‘শূন্যপুরাণ’ এবং দুই ‘অনাদ্যের পুঁথি’।  রামাই শূন্যপুরাণকে ‘আগম পুরাণ’ বলেছেন। তবে রামাই পণ্ডিতের নামে প্রচলিত রচনা সংসায়িত। রামাই পন্ডিত ছাড়া সপ্তদশ শতাব্দীর ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবিদের মধ্যে ময়ুরভট্ট অন্যতম।  রূপরাম চক্রবর্তীর ‘ধর্মমঙ্গল’ পরবর্তীকালের রচনা, তাঁর কাব্য ‘অনাদ্যমঙ্গল’ নামে পরিচিত।  তিনি কাব্যটি সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি রচনা করেন।  লাউসেনের কাহিনিকে ছড়া-পাঁচালী-ব্রতকথার সীমানা ছাড়িয়ে যথাযথ পূর্ণাঙ্গ মঙ্গলকাব্যের রূপ দিয়েছেন।  তিনি গানের দলে যোগ দিয়ে এই ধর্মের গান পরিবেশন করতেন। ধর্মমঙ্গলের আর এক কবি রামদাস আদক চাষী-কৈবর্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর কাব্য ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়েছিল।  কাব্যের বাঁধন চমৎকার। এই কাব্যে অলংকার,   শব্দযোজনা, রূপরীতি  নির্মাণ বিস্ময়কর! সীতারাম দাস ১৬৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন।  কাব্যের কাহিনী পরিচ্ছন্ন ও বিবৃতিমূলক।  যদুনাথের কাব্য সপ্তদশ শতকের শেষের দিকের। বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মমতেও তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।  শ্যাম পন্ডিতের ‘নিরঞ্জনমঙ্গল’ ১৭০৩-০৪ খ্রিস্টাব্দে রচনা।  এখনও বর্ধমানের ‘ধর্মের গাজনে’ তাঁর কাব্য গীত হয়। 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ধর্মমঙ্গলের বিখ্যাত কবি ছিলেন ঘনরাম চক্রবর্তী।  বর্ধমানের কুকুড়া কৃষ্ণপুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়।  ১৭১১-তে তাঁর কাব্য সমাপ্ত হয়।  মহাকাব্যের মত রচনা হলেও পাঁচালীর আদর্শ তিনি পরিত্যাগ করেননি।  মাণিক গাঙ্গুলি ‘ধর্মমঙ্গলে’র একজন বিশিষ্ট কবি, যদিও তাঁর কাব্যের বাঁধনে  শৈথিল্য ছিল। রাঢ়ের ধর্মপূজার খুঁটিনাটি এখানে বর্ণিত।  এছাড়াও দ্বিজ রামচন্দ্র  বাঁড়ুজ্যা, সহদেব চক্রবর্তী,  হৃদযরাম সাউরা  এ শতকের বিখ্যাত ধর্মমঙ্গল কবি ছিলেন।

       আলোচিত মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে বাদ্যযন্ত্রের বহুল উল্লেখ মেলে। উল্লিখিত বাদ্যযন্ত্রগুলির মধ্যে অনেকগুলি এখনও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাদ্যযন্ত্রগুলি তৎকালীন সংগীতচর্চার প্রামাণ্য নিদর্শন। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলির মধ্যে ‘তত-শ্রেণির’ (অর্থাৎ তন্ত্রীবাদ্যের) বাদ্যযন্ত্রগুলি হল—রবাব, স্বপ্তস্বরা, পিনাকিণী, পিনাকী, বল্লকী, খমক ইত্যাদি। ‘আনদ্ধ-শ্রেণির’ (অর্থাৎ চর্ম মুখাবৃত্তী) বাদ্যযন্ত্রের সংখ্যাই বেশি। এগুলি হল—মৃদঙ্গ, জগঝম্প, ডমরু, মোড়া (মড্ডু), দামা, পড়া, ডিন্ডিম, ডম্ফ, ভেরি, দগড়, পাখোয়াজ, জয়ঢাক, জোড়া (জোড় খাই) ইত্যাদি। ‘শুষির-শ্রেণির’ (ফুঁ দিয়ে বাজানো) বাদ্যযন্ত্র হল—শঙ্খ, শিঙ্গা, মুহরী (মধুকারিকা), সানি (সানাই) ও তুরি। ‘ঘন-শ্রেণির’ (অর্থাৎ দ্গাতু নির্মিত) বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঘন্টা, কাঁসর এবং মন্দিরা। এছাড়াও কিছু বাদ্যযন্ত্রের শ্রেণি নির্ধারণ করা যায়নি। এগুলি হল বেণী, দোখন্ডী, ঠনক এবং মঙ্গল। ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যগুলির মধ্যে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলির সবগুলিরই শ্রেণি নির্ধারণ করা গেছে। ‘তত’ বা তালবাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ছিল সপ্তস্বরা ও যন্ত্র। ‘আনদ্ধ’ শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে মর্দল, মুরজ, কাড়া, পড়া (পটহ), ঢাক, ঢোল, বীরকালী, ছাপর, খঞ্জরী বা খঙ্গরী। ‘শুষির’ শ্রেণির বাদ্যগুলির মধ্যে কাহাল, মুহরী (মধুকরিকা), সানি (সানাই), শঙ্খ, ভুরূঙ্গ, তুরি। ‘ঘন’ বাদ্যযন্ত্রের মধ্য উল্লেখযোগ্য হল কাঁসি, মন্দিরা, খঞ্জ, মুচঙ্গ, ঝাঁঝর ইত্যাদি।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve + fourteen =