একাকী

ধ্রুপদ ঘোষ ##

বেল ফুলের চারাটি লাগিয়েছিল চার বছর আগে কোন শীতের দিনে, আজ প্রথম ফুল ফুটেছে। সেই ফুলের দিকে চেয়ে চোখে জল এল শুভেন্দু’র। কত যত্ন নিয়ে চারাটি লাগিয়ে ছিল সে কিন্তু ভাবেনি কোনদিন যে ফুলও ধরবে। পাশের রুমের সরকার বাবু অবশ্য সবসময় আশা দিতেন, বলতেন, ‘দত্ত, অত মরব মরব বলতে নেই। এ গাছের ফুল তুমি ঠিক দেখে যেতে পারবে, সবে তো একাত্তর। আমায় দেখো, আশি – কিন্তু স্টিল ব্যাটিং করছি। অত দুঃখ করো না ভাই।  আমারও তো ছেলে আছে, বৌমা, নাতনি – সব্বাই আছে। কই তারা দেখছে? তোমার নয় নেই, আর থাকলেও যে তারা দেখত, তার গ্যারান্টি কে দেবে! ভগবানও দেবে না ভায়া। তাও ভাইপোকে সব সম্পত্তি লিখে দিয়েছ বলে এই হোমের খরচ দিচ্ছে, নয়ত। আরে ভায়া তুমি ভাগ্যবান, অন্ততঃ ছেলে পুলে নেই। এই শান্তনাটুকু তো দিতে পারবে নিজেকে, আমাদের তো সে কপালও নেই।”

আজ বেশ গরম পড়েছে। বৈশাখ পড়ে গেল অথচ কালবৈশাখীর দেখা নাই। বিকালবেলা গা ধুয়ে বাগানে এসে বসেছে শুভেন্দু। প্রতিদিন সকলে এই বিকেলবেলায় যোগা করে প্রার্থনা ঘরে। আজ তার জন্মদিন। তাই তার মন ভাল নেই। শরীর ভাল নেই বলে বাগানে এসে বসেছে। সকলে ব্যস্ত। বাবুনেরও কি মনে নেই। তিস্তা একালের মেয়ে, এসবের উপর বিশ্বাস রাখে না। শুভেন্দু তার কাছে সে প্রত্যাশা করে না। কিন্তু বাবুন তো একবার তার কাকাকে কল করতে পারে। ছোটবেলায় কই তার কাকা তো একবারও ভোলে নি। গত বছর ওফ্ শোরে ছিলিস, এবার তো দেশে। কত – কত টাকা পাস আর একটা লোকাল কলও করতে পারিস নে। একবার মোবাইল টা চোখের খুব কাছে এনে দেখল। কোন কল এসেছিল কি! না আসে নি।

– আহা, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল সে, বাতাসে গোবিন্দভোগ চালের গন্ধ না! না হোমে কি আজ পায়েস হবে, না – না, আশেপাশে নিশ্চয়ই কোন ভাম ঘুরছে –

– এই হাট হাট, বুড়ো ভাম কোথাকার হঠাৎ আশপাশ দেখে বলে উঠল কিন্তু মনে মনে হাসি পেল শুভেন্দু’র। তিস্তাও তাকে ভাম বলেই গালিগালাজ করত। যাই হোক রিটায়ার্ডমেন্টের পর তিন বছর মেয়েটা অনেক সহ্য করেছে, যদিও দিদিভাইকে ইস্কুল হোক বা পার্ক পৌছে দেওয়া, বাজার হাট এমনকি ঘরের কাজও শুভেন্দু করত। বিপদ হত যখন বাবুন তার কাকা এর হাতের রান্না খেতে চাইত, বৌমা মানে তিস্তা একদম পছন্দ করত না, বলত তেল মশলা খাইয়ে ভাইপোটাকে নাকি শুভেন্দু মেরে ফেলতে চায়। যে ছেলেকে জন্মের ৭ দিন পর থেকে কোলে পিঠে মানুষ করল সে, তাকে মেরে ফেলতে চায় সে!

 – প্রপার ডায়েট জরুরী, আর বুড়ো ভামটা যদি বুঝত। মুচকি হাসি এলো ঠোঁটের কোণে-

পায়েসের কথা মনে আসতেই শুভেন্দু মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল, গোধূলি আকাশে একটা দুটো তারা উঠেছে সবে, প্রতি জন্মদিনে তার মা এক পো দুধে পায়েস রাঁধতেন। যেখানেই থাকুক সে জন্মদিনে মায়ের কাছে যাবেই, একমাত্র মাই তো তাকে ভালোবাসত। ছোট থেকে তার মা তাকে শিখিয়েছে সকলের সাথে মানিয়ে চলতে, সব মেনে নিতে। মা বলতেন – “এ পৃথিবীতে কেউ তোমার সাথে মানিয়ে নেবে না, তোমাকেই মানিয়ে চলতে হবে।” তার মা তাকে মানুষের মতো মানুষ করেছে, তাই তো সে মানুষ হয়েছে কিন্তু ভুলে গেছে সে পুরুষ না নারী না নারীসুলভ।

বাবুন – তিস্তার সংসারে শুভেন্দু মানিয়ে চলত বেশ কিন্তু তাকে নিয়ে তিস্তার লজ্জার শেষ ছিল না। রিজেন্টপার্কের চ্যাংরা ছেলেরা তাকে লেডিস দাদু বলে ডাকত। বাবুন তার কাকাকে খুব ভালবাসে, তাই সে এসব অগ্রাহ্য করলেও তিস্তা কেন মানবে, কেন মানবে তার নারীসুলভ খুড়শ্বশুরের অনাধিকার অনুপ্রবেশ তার সাজানো সংসারে। কমিউনিটির সোস্যাল পার্টি হোক বা তার মডিউলার কিচেনে ডাটা চচ্চড়ি বা রুই পোস্ত, কেন মেনে নেবে সে? তাই শুভেন্দু’র এখনকার ঠিকানা এলিট ওল্ডেজ হোম, পান্ডুয়া।

হটাৎ করে বিলে ডেকে উঠল, এই হোমের একমাত্র পাহারাদার পচা তো কেবল ঘুমায়, তাই এই সন্ধ্যাবেলায় বিলে ঘুমিয়েই কাটায় – সারা রাত জাগতে হয় তো। আবার একবার ভৌ ভৌ করতেই শুভেন্দু বলল – কিরে বিলে ওরকম করছিস কেন?

ডাক থামিয়ে বিলে শান্ত চোখে চুপ করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ শুভেন্দুর দিকে – যেন ও শুভেন্দুর দুঃখটা বুঝতে পেরেছে তারপর আবার মুখ গুজে শুয়ে পড়ল। শুভেন্দু মনে মনে আক্ষেপ করে বলল – ভগবান কেন যে আমায় বানালেন, নয়ত সব দিলি তাবলে শরীর দিলি না কেন? হ্যাঁ শরীর তার নেই, সাড়ে সাত বছর সবরকমের সম্পর্ক রাখার পরও একজন বলেছিল – 

তুমি একদম আমার মনের মত, আমি ঠিক যেরকম বউ চাই, তুমি একদম সেইরকম কিন্তু তুমি মেয়ে নও, তোমার শরীরটাও যদি মেয়ের মতো হত, তাহলে তোমায় আমি …

মাথা নেড়েছিল শুধু, উত্তর করেনি। যৌবন কিংবা প্রৌঢ়ে কতজনে আদর করতে করতে বলেছিল – ইস্, তুমি যদি মেয়ে হতে তাহলে তোমাকেই বিয়ে করতাম। এসব কথা মনে পড়লে হাসি পায় এখন তার। কেউ বা আসত সময় কাটাতে, কারর ছিল বা শুধুই শরীরের ক্ষিদে। কেউ বাসত ভাল তার হাতের রান্নাই  কেবল বা কারোর কেবলই মানসিক ক্ষিদে, যাই হোক না কেন আসত, শুভেন্দুর অবাক লাগত, কেন তারা অন্ধ সকলে! প্রথম দেখায় কেন তারা বুঝত না যে তার কাছে শরীর নেই, আর শরীর যখন নেই তাহলে কিসের টানে আসত তারা – কে জানে! তবু প্রত্যেক জনের চলে যাওয়ার পরও শুভেন্দু অপেক্ষা করত, একজন তো আসবে একদিন – যে ভালবাসবে, সত্যিকারের ভালবাসবে আর বলবে – শুভ তুমি যেমনই হও না কেন, আমি তোমায় ভালবাসি, আমরা দুজনে থাকব চিরকাল। আসে নি যে – ভুল নয়, এসেছিল। রামেশ্বরপুরে প্রাইমারী ইস্কুলে যখন চাকরী করত, একদিন ইস্কুল ফেরত এক পাগল ছোকরা পথ আটকে বলেছিল – “ভালবাসি তোমায়, সারাজীবন সাথে থাকব। বিশ্বাসঘাতকতা করব না।” দেখতেও মন্দ ছিল না। ফরসা, লম্বা তবে একটু রোগা। কেন তাকে না বলেছিল শুভেন্দু তা জানে না। হয়ত চাষা বলে? না তার সেই সময়ে অহংকার – কোন কারণে সে সেদিন লোক ডাকিয়ে পিটিয়েছিল ঐ নিরীহ লোকটাকে – তা ঈশ্বরই জানেন।  সাহসের সাথে প্রেম নিবেদন – এ তো অন্যায় নয়। তবে! একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সে – হয়ত সেই অন্যায়েরই শাস্তি আজ সে পাচ্ছে আর হয়ত আরও পেতে হবে। তাই তো আর কেউ আসে নি, হয়ত নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্য কেউ কখনও আসে না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভাবল, আজ আর আসবে না -কোন কল! বাবুন হয়ত ব্যস্ত খুব।

অথচ সকলের জন্মদিনে ফোন করে সে, তাদেরকেও যারা আজ ভুলে গেছে তাকে। সকলের জন্মদিনে পায়েস করে পাঠাত সে, এখনও sms পাঠায় কিন্তু তার কথা কেউ মনে রাখে না। আজও রাখে নি।

হঠাৎ অফিসের ফোনটা বেজে উঠল। লুঙ্গির কুচিটা বাঁ হাতে ধরে দ্রুত গতিতে পা বাড়াল অফিসের দিকে, বেরিয়ে আসছে পচা।

– কার ফোন রে পচা..

– ক্যান, তোমার কিডা হয়? 

– না, এমনি, ভাবলুম  আমার কল

– ক্যান তোমায় কেডা কল করুম, দাদু!!

– মরণ, মুখ বেকিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসে শুভেন্দু। না প্রতি বছরের মতো এবারও হয়ত, আসলে ৭১ এ এসেও তার জন্মদিন মনে রাখার মত আর বোধহয় কেউ অবশিষ্ট নেই। চোখ মুঝে উঠতে যাবে, পিছন থেকে কে যেন চোখ টিপে ধরল, 

– কে কে ?

– happy birthday to you, happy birthday to you, Happy Birthday মিষ্টিদাদু

– তিয়াসা, 

চোখ ছাড়তেই হ্যাঁ – ঠিক সে, ৩৬ বছরের ডিভোর্সী সিঙ্গল মাদার, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে যুক্ত। মা হতে পারে নি বলে, বর ছেড়েছে কিন্তু দত্তক মেয়ে ছাড়াও এই ওল্ডেজ হোমের এতগুলো বুড়ো বুড়ির মা হয়ে উঠেছে। হাত ধরে টানতে টানতে তাকে ডাইনিং নিয়ে গেল তিয়াসা।

– এসো, শিগগিরই এসো।

– ওরে মুখপুড়ী পড়ে যাব যে।

ডাইনিং এ মাঝের টেবিলে একটা কেক আর এক বাটি পায়েস, কেকের উপর ৭১ লেখা মোমবাতি, সকলে ঘিরে দাড়িয়ে, সরকারদা, শ্যামল, বুলুদি, অনিতা, পচা , তিয়াসা, তিন্নি সকলে।

হাতের মোবাইলটার দিকে তাকাল শুভেন্দু, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল, মনে মনে বলল – ভালই করেছিস বাবুন কল না করে, তুই কল করলে হয়ত আমি এতকিছু পেতাম না। পেতাম না রে, সত্যি পেতাম না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × two =