চৈতালি রাগ

    চিত্রা দাশগুপ্ত #

বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছিল ‍‍অনন্যা, পড়ায় মন বসেছে না আজ।  এক ঝলক উদাসী হাওয়া ঘরের ভেতর ঢুকে কি যেন এক যাদুর পরশ দিয়ে গেল ওকে । বাইরে টুপ টাপ করে খসে পরল গাছের বিবর্ণ শুকন পাতাগুলো, ঝরে পরল কিছু কৃষ্ণচূড়া। বেল,  যুঁই,  করবি,  আমের মুকুলের গন্ধে চার দিকটা মোহিত,  মৌমাছির ডানার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। দূরে মাছরাঙা পাখিটা তার সুন্দর রঙিন ডানা মেলে উড়ে উড়ে শিকার ধরছে। চৈতালি শেষ বেলার সোনালি রোদ চার দিকে যেন এক অলস মায়ার সোনালি জালে বিছিয়ে দিয়েছে। জল ফড়িং,  প্রজাপতি সবাই যেন আত্মহারা, করুণ সুরে ঘুঘু পাখিটা ডাকছে তার সঙ্গিনীকে,  বেচারা …

সশব্দে কেকার মেসেজ ঢুকল  ফোনে, ”আমি আজ ক্লাসে যাব না,  তুই একা চলে যাস,  পরে আমি তোর কাছ থেকে সব জেনে নেব।”

উফ্ঃ, এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না,  নিশ্চয়ই বয় ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে,  পরীক্ষা বলে ওর কোন ভয় ডর নেই !

কিন্তু অনন্যাকে যেতেই হবে,  নেক্সট পেপারের কিছু ডাউট আছে,  ক্লিয়ার করতে হবে। তাছাড়া আর কটা দিনই বা ক্লাস হবে,  নেক্সট উইকে পরীক্ষা শেষ,  তারপর কি আর দেখা হবে স্যারের সাথে ? পাশ ও করবেই আর তারপর মাস্টার ডিগ্রীতে ভর্তি হবে,  বাড়ির থেকে বিয়ের কথাও হচ্ছে…

ধুর ভাল্লাগছে না,  বইটা রেখে উঠে পড়ল,  ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল অনন্যা। চৈত্রের পড়ন্ত রোদের তাপে কেমন একটা গুমোট গরম,  এক ঝাঁক চিল উড়ছে আকাশে,  ঝড়ের পূর্বাভাষ। দূরের পলাশ গাছের শাখায় যেন আগুন লেগেছে,  কি অপূর্ব শোভা। ঐ পলাশ তলায় কিছু দিন পর বসবে চড়কের মেলা,  ঢাক ঢোল বাজিয়ে দূর দূর থেকে আসবে গাজনের সন্ন্যাসির দল, উপচে পড়বে ভীড়। 

হঠাৎ এক ঝলক ঐ মন কেমন করা হাওয়া এসে দুষ্টুমি করে ওর ওড়নাটা উড়িয়ে দিল, ঘাড়ের ওপর বেঁধে রাখা হাত খোঁপাটা খুলে চুলগুলো ছড়িয়ে  পরল ওর বুকে পিঠে মুখের ওপর ! ‍অকারনে এক হাসির ঝিলিক খেলে গেল ওর ঠোঁটে, গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকে গেল অনন্যা।

সুশ্রী, সুত্বন্নী অনন্যা চট়্পট়্ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। আকাশের কোনে কালো মেঘ জমেছে, থমথমে পরিবেশ, কাল বৈশাখী আসবে হয়তো ! প্রকৃতি যেন বড়ো রুক্ষ, বিদগ্ধ, অবসাদে বিষন্ন তৃষিত এক রূপ ধারণ করেছে, দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পলাশ, সিমুল, কৃষ্ণচূড়ার, পর্ণমচি বৃক্ষের সারি ।…একটা ককিল একটানা কলতানে সাথীকে আহ্বান করে গাইছে বসন্ত বিলাপ ! হাওয়াতে ধুলো বালি উড়ছে, দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছে অনন্যা স্যারের বাড়ির দিকে। 

স্যার, শ্রী সন্দীপন সান্যাল, অধ্যাপক। সুপুরুষ চেহারা, পড়াশোনাতে বরাবর প্রথম সারিতে, ভালো গান করেন, ছবি আঁকাতে ও সিদ্ধ হস্ত। যাকে বলে শান্তিনিকেতনের এক টোটাল প্যাকেজ। অনেক ছাত্রীর হার্ট থ্রব।  লেখাপড়া শেষ হবার পর আর ছেড়ে যেতে পারেননি শান্তিনিকেতন।  পড়া শেষ হতে হতেই ওখানেই একটা অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলেন। এখন প্রোফেসার কলোনিতে এক ছোট্ট বাড়িতে একা থাকেন। বিকালে ছাত্র ছাত্রী পড়ান। আজ খালি কেকা আর ওর আসার কথা, ওদের আর একটা পেপার পরীক্ষা বাকি আছে। 

দরজার বেল বাজাতে স্যার দরজা খুলে, ——“তুমি একা ? ভিতরে এসে বসো, আমি যাই চট করে দুটো মোম কিনে আনি, মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে,   কারেন্ট যেতে পারে, মোম নেই,

আমি আগে দেখিনি …”বলে স্যার বেরিয়ে গেলেন। 

আকাশটা কালো হয়ে ঝুলে যেন নিচে নেমে এসেছে, হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।মেঘের গুরু গুরু চাপা গর্জনের সাথে বিদ্যুৎ শিখা যেন আকাশের বুকে আগুনের আলপনা আঁকছে। হঠাৎ দমকা ঝোড়ো বাতাসে ঢুকে ঘরের ভেতর সব লন্ড ভন্ড করে দিল। টেবিলের ওপর চাপা দিয়ে রাখা কিছু কাগজ পত্র উড়ে ছড়িয়ে পরল চারদিকে। ঝড় উঠেছে, সব কুজ্ঝটী মিলিয়ে,  প্রলয় শঙ্খ বাজিয়ে আজ কালবৈশাখী আসছে। 

মাটি থেকে ক্ষিপ্র হাতে কাগজগুলো কুড়িয়ে নিয়ে টেবিলে রাখতে গিয়ে অনন্যার চোখ পড়ে গেলো একটা কাগজে, জলরংএ আঁকা ওর একটা ছবি পাশে লেখা, ”তুমি রবে নীরবে হ্রীদয়ে মম….”। আরো একটাতে ওর ছবি পাশে লেখা ”তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা আমার সাধের সাধনা…”

আরো, আরো, ওর সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো, স্যার কি ওর মনের গোপন কথা টের পেয়ে গেছেন। ওকি অসাবধানে কিছু ….দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল অনন্যা । বিশাল শব্দে একটা বাজ পড়ল। 

ঠিক তখনই সন্দীপন এসে ঘরে ঢুকল। মোমটা জ্বেলে রাখল টেবিলে।  কাগজগুলো দেখে ওর বুঝতে বাকি রইল না যে ‍অনন্যা কাগজগুলো দেখে ফেলেছে।  সন্দীপন বুঝতে পারছে না কী করবে, কী বলবে?

অনন্যা কি ওকে ভুল বুঝবে ? অনেক বার বলতে চেয়েছে মনের গোপন কথাটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি। হাতে আর সময় ও বেশি নেই,  কিন্তু ও হারাতে চায় না অনন্যাকে।  

বাইরের ঝড় বইছে সন্দীপের মনে ও তার ছোঁয়া লেগেছে, মোমের আলোটা বাতাসে  দপ্ দপ্ করছে, নিবে না যায়!

পায়ের শব্দে ততক্ষণে অনন্যা মুখে তুলেছে। ওরা কেউ কিছু বললো না।  বাইরে ঝড় থেমে বৃষ্টি নেমেছে। অনন্যার সব ডাউটগুলো ক্লিয়ার করে ক্লাস শেষে করে সন্দীপন অনন্যাকে ইতস্তত করে বলল, ”চলো তোমাকে একটু এগিয়ে দি,  আপত্তি নেই তো ?” 

একটু চুপ করে থেকে অনন্যা মাথা নেড়ে জানাল তার আপত্তি নেই। ওরা বাইরে বেরিয়ে এল।  তখন বাইরে আকাশে চৈতালি পূর্ণিমার মায়াবী  চাঁদ হাসছে। জোছনার আলোতে ভিজে ওরা এগিয়ে চলল। 

মায়াবী চাঁদকে সাক্ষি রেখে মনে মনে কি ওরা মন দেয়া নেয়া করল?

পয়লা বৈশাখ :  হোয়াট্স আ্যাপে সন্দীপনের মেসেজ

” ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে 

আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে 

আমার পরাণে যে গান বাজিছে 

তাহার তানটি শিখো তোমার চরণমঞ্জিরে “…..   

 শুভ নববর্ষ !

‍অনন্যা মেসেজটা পড়ে ঠোঁট কাম়্ড়ে হাসিটা সামলে নিল, কান দুটো গরম হয়ে গেছে ওর, বুঝতে পারছে না কি উত্তর দেবে ।অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে, হাতের পাতা দুটো ঘামছে। দুষ্টু হাসি হেসে ও চট পট লিখে দিল,

”বধূ কোন আলো লাগলো চোখে 

দীপ্তি রূপে ছিলে সূর্যলোকে, বধূ কোন আলো লাগলো চোখে 

ছিলো মন তোমারি প্রতিক্ষা করি …”  

হাত কাঁপছে,  থাক্ এটুকুই .…সেন্ড করে দিল অনন্যা ।

হোয়াট্স অ্যাপে স্টেটাস দিল —

“তুহু মম মন প্রাণ হে, আমি তটিনী সম তোমারি সাগরে মিশে যাই….”। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × three =