ডিসেম্বর

সঞ্জীব সেন, পানিহাটী, উত্তর ২৪ পরগনা

 

বছরের এই সময়টা তুষারবৃত থাকে। প্রতিদিনের মত আজ রাতেও বেরিয়েছিল। তার এপ্রোনের ভিতর কয়েক বান্ডিল দেশলাই বাক্স রাখা আছে। হাত দিয়ে দেখে নিচ্ছিল। কিশোরী মেয়েটির মাথায় টুপি ছিল না। আর পাও ছিল খালি। একটা বেঢপ সাইজের চটি পরে বেরিয়েছিল। চটি জোড়া ওর মায়ের ছিল। একটা ঘোড়ার সঙ্গে ছোটাছুটি করছিল। নিজেকে সামলাতে পারেনি, চটি খুলে গেছিল। একটা বাচ্চা ছেলে হাতে নিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছিল। বাচ্চা বয়সের ছেলেমানুষি ছিল। তারপর থেকে খালি পায়েই ঘুরেছে। একটা দেশলাই বিক্রি করতে পারেনি। খালি হাতে ফিরে গেলে বাবা খুব মারবে। তাই রাতে ফিরবে না। দুটো দোকানের মাঝে এক টুকুরো জায়গার মধ্যে বসার মত জায়গা ছিল। বরফের হাত থেকে তো বাঁচা যাবে। ঠান্ডা হাওয়ার থেকে বাচতে গেলে আগুন প্রয়োজন। এসব ভুলিয়ে দিয়েছিল বাড়ির ভিতর দিয়ে ভেসে আসা রাজহাসের রোস্টের সুস্বাদু গন্ধ। নিঃশ্বাসের সাথে যতটা পারছিল টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। ওর পা ঠান্ডায় রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। তখন আপ্রনের ভিতর থেকে একটা দেশলাই বাক্স বের করে এনে একটা কাঠি জ্বালাতেই প্রদীপের শিখার মত জ্বলে উঠল, দেখতে পেল সে তো পায়ে পাদানি দেওয়া মাথায় মুকুট পরানো একটা উনুনের পাশেই বসে আছে। মোমবাতির শিখাটা প্রদীপের মত জ্বলছিল। তাতে হাত রেখে উত্তাপ নিচ্ছিল।

আর তখনই দেশলাই এর আলোটা নিভে গেল। আর স্বপ্নটাও হারিয়ে গেল। কাঁধ অবধি নেমে আসা কোঁকড়ানো চুলে বরফের টুকরোগুলো স্তুপকারে জমা হয়ে উঠছে। আর এসব ভুলিয়ে দিয়েছে সামনের বাড়ি থেকে সুস্বাদু রান্নার গন্ধ আর মোমবাতির আলো। মেয়েটি ক্ষিদে আর ঠান্ডায় খোঁড়াচ্ছিল। তারপর মেয়েটি আরেকটা দেশলাই জ্বালাল। ফস করে জ্বলে উঠল। আর দেখতে পেল সামনে একটা যবনিকা আর সরে গিয়ে একটা বাড়ি একটা ছোট টেবিল পাতা সামনে খাবার ধোঁয়া ওঠা রোস্ট, মেয়েটা ভাবতে লাগল এবার দেখল সাদা টেবিলক্লথ পাতা টেবিল থেকে মাংসের টুকরোটা মাটিতে পড়ে গেল আর মাংসের ভিতর কাটা চামচ গাথা। আর টুকরোটা ওর কাছেই এগিয়ে আসছে। আর তখনই মোমবাতির মত স্বপ্নটাও নিভে গেল।

আবার একটা দেশলাই জ্বালাল এবার সে দেখতে পেল সে একটা ক্রিসমাস ট্রির নিচে দাঁড়িয়ে গাছটা খুব সাজানো গোছানো। দোকানের স্যোকেসে সাজানো ছবির মত এই গাছগুলো আলোয় ভরা ছিল। আর যেই ছুঁতে যাবে তারাগুলো স্বর্গের তারা হয়ে গেল। একটা তারা খসে পড়ল গাছ থেকে।

নিশ্চয় কেউ একজন মারা গেছে বলে উঠল মেয়েটি!

ও জানতো কেউ মারা গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়।

ও জানতো তার ঠাকুরমা এরকমই তারা হয়ে গ্যাছে।

মেয়েটা ঠাকুরমা বলে ডুকরে কেঁদে উঠল আর বলল আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও

দেশলাই বাস্কের সব কটা আলো জ্বালিয়ে দিল দেখল ঠাকুরমাকে আগের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর আর লম্বা লাগছে। ঠাকুরমা ওকে কোলে নিয়ে অনেক উপরে নিয়ে গেল যেখানে ক্ষিদে তৃষ্ণা ঠান্ডা কিছুই নেই।

আণ্ডারসনের ”লিটল মার্চ গার্ল” এই গল্পটাকে নিয়ে শিশু নাটক করে ছিল বেলফাস্টের এক আইরিশ চিল্ড্রেনস স্কুল। আর সেই লিটল মার্চ গার্ল আজ সত্তর বছর পেরিয়ে আশি বছরের এক বৃদ্ধা। বয়সের ভারে নুব্জ হলেও প্রাণ প্রাচূর্যে ভরপুর ও আমুদে। ট্রিনিটি ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপে ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়া এক মহিলা, যার সর্বশেষ উপন্যাস “December is not mere a December for me” আত্মপ্রকাশের এক মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় বার মুদ্রন হতে চলেছে। মেল বার্তায় জানিয়েছে। সম্ভবতঃ ম্যানবুকার এর জন্য নমিনেট হতে পারে মেলবার্তায় একথাও লিখে পাঠিয়েছে। মেলের প্রিন্ট আউট বার করে তার হাতে দিয়ে গেছে সর্বক্ষনের দেখাশোনার জন্য যে মহিলা ম্যাডাম কারি। মাস খানেক হল মাঝবয়সি এই ক্যারি এসেছে। এর আগে লিন্ডা বলে যে মহিলাটি থাকত বয়সের সীমান্তে এসে বিবাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার বাল্যকালের বন্ধুর সাথে। ওদের গল্পটাও একটা রিয়েল লাভ স্টোরি হতেই পারে। আসলে মানুষ যত জীবন অতিবাহিত করে ততোই অজান্তে গল্প হয়ে ওঠে। যাকে জীবনচরিত বলা যায়। ডিসেম্বর মাসটা শুধু মাত্র একটা মাস না। এই ডিসেম্বরেই জড়িয়ে আছে তার জীবনচরিত তা ম্যাডাম ক্যারি জানে না। তবে তার ম্যাডাম যে বেশ কিছু দিন ধরে খুব আপন মনে আছে সেটা লক্ষ্য করেছে। ম্যাডাম ক্যারি বলল আজকের গার্ডিয়ানের সাপলিমেন্টারিতে আপনার উপন্যাসের একটা দীর্ঘ সমালোচনা লিখেছে এটা আপনি হয়ত খেয়াল করেন নি।

উত্তরে অ্যানা বার্নস বলেন আসলে আজকে মনটা ভাল নেই। পড়া হয়নি পড়তে হবে ক্যারি তুমি একটা কফি নিয়ে এসো। তোমার কি ডিনারের কাজ হয়ে গেছে। যদি হয়ে থাকে একটু বসো না। আসলে আজ আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। অনেক তো লিখলাম।

ম্যাডাম ক্যারি বলল গার্ডিয়ান বলছে আপনার এই লেখাটা নাকি বুকার কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। এবারের ম্যানবুকার আপনার নাম থাকলেও থাকতে পারে। আর তার সাথে এও বলেছে। এই গল্প নাকি লেখিকার দীর্ঘ জীবনের ইতিহাস। এই প্রশ্নের উত্তরে আ্যানা কোন কথাই বলেনি চুপ করেছিল। ক্যারিও কফি আনতে চলে যায়।

রাজধানী শহর ডাবলিন থেকে লিসবার্ন চলে এলাম। বাগান ঘেরা সুন্দর ছিমছাম সেই শৈশবের গন্ধ মাখা বাড়িটা বিক্রি করে লিফি নদীর পাশে লিসবার্ন চলে এসেও বাবার উৎশৃঙ্খল জীবনে একটু পরিবর্তন হল না। বেলফাস্ট আইরিশ চিল্ড্রেনস স্কুলটা ছিল কেভ হিল কাউন্ট্রি পার্কের কাছে। সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছিল বেলফাস্ট লাগান নদী। এখানেই টাইটানিক জাহাজটা তৈরী হয়েছিল। জোনাথন সুইফটের গালিভার ট্রাভলস এখান থেকেই লেখা হয়েছিল। প্রাণ প্রাচূর্যে ভরা এই শহরেই আমার শৈশবের দশটা বছর কেটেছে। তারপর ট্রিনিটি কলেজে পড়তে যাওয়া। ডাবলিনের কেমব্রিজে ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে স্কলারশিপ পড়ার সময় ফিলিফসের সঙ্গে আলাপ ও সোসিওলজি নিয়ে পড়ছিল। ওর বাবা হারল্যান্ড এন্ড উল্ফ শিপ কোম্পানীতে চাকরি করত। অ্যানা ভাবছিল ফিলিপসের সঙ্গে ওর প্রেমময় জীবনের সব ঘটনা। ছবির মত ভেসে ওঠছিল মাঝে মধ্যে হারিয়েও যাচ্ছিল, আবার ফিরে আসছিল। তখনই ম্যাডাম ক্যারি টেবিলে কফিটা রাখল। ব্ল্যাক কফি। আনা ম্যাডাম ক্যারিকে বলল আলমারির ভিতর দিয়ে অ্যালবামটা নিয়ে এসে বসো। এই সময় ফাঁকাই থাকো। আজ আমার সঙ্গে একটু গল্পই না হয় কর। ক্যারি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল।

অ্যানা হঠাৎই প্রশ্নটা করল, আচ্ছা তুমি বিয়ে করলে না কেন! হঠাৎ এমন প্রশ্নে ক্যারি সামান্য বিচলিত হয়ে যায়। নিজেকে অপ্রস্তুত লাগে। জীবনের সায়াহ্নে এসে এমন প্রশ্নের উওর দেওয়া মানেই নিজেকে ফিরে দেখা। ক্যারি নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। তার পর বলল,  ম্যাডাম মানে,  আসলে সব মেয়ে যে বয়সে প্রেমে পড়ে সে ভাবেই আমিও পড়েছিলাম, ডিফোর সঙ্গে আলাপ আমার বোনের ম্যারেজ এনগেজমেন্টে আমার বোনের হাসবেন্ডের আত্মীয়। আমার তখন পঁচিশ আর ডিফোর পঁয়ত্রিশ এর কাছাকাছি। আমরা দুজনাই প্রেমে পড়লাম। তারপর হঠাৎই আমাদের আয়ারল্যান্ড ছেড়ে কার্ডিফ চলে যেতে হল। বাবার আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু আমাদের সংসারে দুঃখের যবনিকা পরল। কার্ডিফে মামার বাড়ি গিয়ে উঠলাম। পরিবারের দায়িত্ব আমার উপরে। মা নিজের ভাই এর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে পারল না। বোনের ডিভোর্স হয়ে বাড়িতে ফিরে আসা; ভাইটাকে নেশারু হয়ে উঠতে দেখতে দেখতে মাও কেমন নিথর হয়ে উঠল। গোটা পরিবারের দায়িত্ব আমার উপরে। কার্ডিফের এক সরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ পেয়েছিলাম। একজন ভাল মানুষের দৌলতে। কম বয়সি সুপুরুষ কার্ডিফে এক কলেজের প্রফেসর। অমায়িক ওনার বাড়িতে গেছিলাম, হারমোনিকা বাজাতে পারে। এক মনে বাজাচ্ছিল। আমি বাইরে দিয়ে শুনেছিলাম। তিনিই কাজটা করে দিয়েছিলেন। তারপর সময়ের সাথে গোটা পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। আর নিজের কথাটা ভাবা হল না।

ক্যারি বলল দেখুন ম্যাডাম নিজের কথা বলতে গিয়ে কত দেরি হয়ে গেল, আসলে বলা না দেখা। নিজেকে খোঁজা, আপনি ডিনার করবেন তো,  তাহলে ডিনার রেডি করি, আ্যানা বলল আমার নাতনি এলিয়া কি ফোন করেছিল? ক্রিসমাসের এক সপ্তাহ এখানে কাটিয়ে যাবে। আজ ফোন করার  কথা। ফোন  করেছিল!

না এখনও করেনি,

ক্যারি তুমি খাবার এখন দিও না,  একটু পরেই খাবো,

ক্রিসমাসের আলোয় গোটা শহর সেজে উঠেছে, এই সময় আবহাওয়া বেশ মনোরম। রাতের দিকে তুষারপাত হয়। ক্যারির কথাগুলো ভাবছিল আর নিমগ্ন ছিল। কার্ডিফের যে হাসপাতালে চাকরি করে দিয়েছিল যে ছেলেটার নাম ফিলিপস  আর হারমোনিকা বাজাতে পারে। কেন জানি না মনে হচ্ছে এই ফিলিপস  কি সেই ফিলিপস  যার সঙ্গে জীবনের সব চেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটিয়েছিলাম। হরমোনিকার সুর ভেসে আসছিল হতে পারে মনের ভুল কিন্তু পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিল। চোখের সামনে ছবির মত দেখতে পাচ্ছিল ট্রিনিটি কলেজে সোসিওলজি পড়তে এসে লেবার পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। আমার সাথে আলাপ প্রেমে পড়া সবই এই ডিসেম্বর। তাই এই ডিসেম্বর দারুণ প্রভাব ফেলেছে এই জীবনে। ফিলিপস ছিল খুব প্রানোচ্ছল একটা ছেলে। ছোট করে কাটা চুল। দুদিনের দাড়ি না সেভ করা লুকে হেব্বি লাগত, মোহিত হয়ে গেছি। আমিই কয়েক পা এগিয়ে বলেছিলাম আমাদের বন্ধুত্বের এই সম্পর্কটিকে এগিয়ে নিয়ে গেলে কেমন হয়।

ফিলিপস হয় তো ইচ্ছে করেই বলেছিল, ঠিক বুঝতে পারলাম না

তখন উইলো গাছটার পাতায় সবুজ রং গাঢ় হয়ে উঠেছে। বললাম মানে আমাদের রিলেশনটাও প্রেম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় না?

ফিলিপস হেসে বলেছিল এর উত্তর দিতে গেলে একটু সময় লাগবে। বলেছিলাম কেন মিস্টার তোমার জীবনে আরো কেউ আছে নাকি?

কথাটা বলেছিল দুদিন পর , আর আমার প্রতিটি প্রহর কেটেছিল দুর্বিসহ এক আনন্দে। ফিলিপস আর আমি চার্চে গিয়ে প্রেয়ারের মধ্যে যাত্রা শুরু করলাম জীবনের। হারমোনিকায় একটা গান শুনিয়েছিল লেননের অন্ধ ভক্ত, পল ম্যাককার্টনির লেখা গানে ”মাই ওয়ে, আর রেবেল রেবেল”। গানটা ও শুনিয়েছিল। তখন ফিলিপসের ভিতর বামপন্থী প্রভাব দৃঢ় করে তুলেছিল। আমাদের প্রেম চলছিল মৃদু লয়ে। আমরা মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম জীবন শুরু করার। ঠিক তখনই ক্যারি টেবিলে খেতে ডাকল ,

ডিনারে বসে সামান্য একটা সুপ খেয়েই উঠে পড়েছিল,

একটু পরে এলিয়ার ফোনটা এল।

এলিয়া ফোন করছে। কার্ডিফ হসপিটালে নিজস্ব ডক্টর কোয়াটার থেকে, কার্ডিফের হাসপাতালের সাইক্রিয়াটিস হিসাবে জয়েন করছে। ভাবা যায়। সেই ছোট কিম বড় হয়ে উঠল বিয়ে দিলাম। বিয়ের বয়স হতেই ওর পছন্দের ছেলে দেখে বিয়ে তারপর ওর ছেলে ডিলন, ওর বিয়ে তারপর এলিয়া। এলিয়াও লেডি ডক্টর হয়ে উঠল। আর আমিও কেমন শিকড় ছড়িয়ে বৃক্ষের মত দাঁড়িয়ে আছি।

শুয়ে পড়ে অন্য দিনের মত তাড়াতাড়ি ঘুম এলো না। ইচ্ছা করেই এন্টি ডিপ্রেসড ওষুধ খাইনি। অশান্ত মনটা উদভ্রান্তের মত ঘিরে ধরছে বারবার। ট্রিনিটি কলেজ গ্রাউন্ড আমি আর ফিলিপস। নিজেদের প্রেমের আগুনে নিজেরাই পুড়ছি। রেসিং সাইকেলে সামনে বসে বিস্তারিত বিকালে রিভার রোড ধরে পেরিয়ে গেছি। কলেজের সময়টুকু যেন প্রাণ ফিরে পেতাম। বাড়িতে ফিরে এলেই সেই বাড়ির বিধস্ত পরিবেশ। কিম তখন দশ বছরের ছোট্ট একটা ডল পুতুলের মত মেয়ে। আর ভাই বুন ছিল জন্ম থেকে পোলিও আক্রান্ত হুইল চেয়ারে এগিয়ে এসে গাল ছুঁয়ে যেত। আর কিমও। আর বাবা আমি এলেই বেরিয়ে যেত। আর ফিরত অনেক রাত করে। আমি জেগে বসে থাকতাম। মা বেঁচে থাকতে নেশা করত না কোনদিন। আর এখন প্রতিদিনই ড্রাঙ্ক হয়ে বাড়িতে আসে। খাবার ছুড়ে ফেলে দেয়। এ যেন নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে উঠছিল। পালাতে চাইতাম। ফিলিপসের সঙ্গে। দূরে কার্ডিফে ওদের নিজেদের বাড়িতে। তখনই ফুটে ওঠত পোলিও আক্রান্ত ভাই আর বোনটার মুখ। নিষ্পাপ দুটো মুখ। ওরা আমাকে ছাড়া কিছু জানে না।

তখন সামার আমি পোস্ট গ্রাজুয়েট করে স্কুলের চাকরির চেষ্টা করছিলাম। ও সোসিওলজি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার তোড়জোড় করছিল সেদিন সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। কলেজে এসেছিলাম। আসলে একটু নিজের জন্য সময় দিতে চাইছিলাম। ফিলিপসের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে। ভাই আর বোনদের সমস্ত আবদার মিটিয়ে আসতে হত। মা সব সময় বলত তুই বড় সবার থেকে। তাই স্যাকরিফাইস করতে হবে তোর অনেক কিছুর থেকে। সেদিন ফিলিপস আমি গিয়েছিলাম। সাইকেলে না হেঁটে

ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় দিয়ে। কমিউনিটি হাউসের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ঘরের ভিতর দিয়ে মিউজিক ভেসে আসছিল। বেস গিটারের সাথে সাক্সোফোন। আরোও কিছু মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল হয়ত কোন মিউজিক কনসার্ট পোগ্রাম হচ্ছিল। আমরা ভিতরে যেতে চাইলে গেটকিপার নিজেই গেট খুলে দিল। ফাঁকা হলে আমি আর ফিলিপস। আর স্টেজে মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্টগুলো বাজাচ্ছিল।

জন লেননের ইমাজিন, “ইমাজিন দেয়ার ইজ নো হেভেন” ।

আমরা প্রথমবার চুম্বন আবিষ্ট হলাম। হয়ত পরিবেশ পরিস্থিতি ইশারা বুঝেছিল।

হঠাৎই হলের সমস্ত স্পটলাইট এক যোগে জ্বলে উঠল আর আমরা দুজনাই বেশ লজ্জায় পড়ে গেছিলাম। স্টেজের মিউজিক ডিরেক্টর ওর পরিচিত। উনি স্টেজ থেকে নেমে এসে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাল। ভদ্র মার্জিত লোকটি আমাদের দুজনার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমাদের দুজনকে এক ফ্রেমে নেওয়ার মত করে দেখছিল। আমার ঠোঁটে ফিলিপসের ছোঁয়া সারা শরীর রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল। জীবনের প্রথম মনে হল যৌবনের ভিতরেই থাকে অপরাধ প্রবণতা। বাড়ি ফিরে সেই প্রতিদিনের চেনা ছবি। ভাইবোনের জন্য চকলেট পেস্ট্রি নিয়ে যেতে হত। সে দিনও নিয়েছিলাম। আর বাবা প্রতিদিনের মত বেরিয়ে গেল। বাবার সঙ্গে কথা বার্তা কমে আসছিল।

রাতের বেলা স্বপ্ন দেখে ধরফড় করে উঠে বসলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম, দেখলাম পালাবো। কাউকে না জানিয়ে পালাবো। রাতের অন্ধকারে আইরিশ সাগরের বুক ঘেঁসে দশ ঘন্টার পথ পেরিয়ে কার্ডিফ পৌঁছব, ফিলিপস জাহাজঘাটে দাঁড়িয়ে থাকবে। ও বলেছিল ভাবতে। ও কোনদিন বলেনি পালিয়ে এসো আমিই চেয়েছি। মাকে দেওয়া সব কথাকে পুরো অস্বীকার করেই পালাতে চেয়েছি। আজ রাতেই পালাবো। মাথায় কান অবধি ঢাকা হ্যাট গায়ে শীতের ভারি পোশাক। তুষারপাত হয়েছে। ভোরবেলায় সাফাই কর্মীরা নিজেদের কাজ করছে। স্টেশন থেকে কিছুটা পথ এগিয়েই ফেরিঘাট। স্টেশনে নেমেই দেখলাম ফিলিপস দাঁড়িয়ে আছে। আমি নামতেই ট্রেনের ভিতর সাফাই কর্মীরা ঢুকে কাজ করতে শুরু করল। ভোরের প্রথম ট্রেন। ফিলিপস বলল এসো যাওয়া যাক। তখন কিম পেছন থেকে ডেকে উঠল ঘুরে তাকালাম কিম একা নয় বুন হুইল চেয়ার করে এগিয়ে আসছে। আর একটা চুম্বকীয় শক্তির চেয়েও ভারী একটা ঝড় আমাকে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফিলিপস দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক ভাবেই। আর তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। চোখ লেগে আছে। ফিলিপসের প্রথম ঠোঁটের ছোঁয়া এই স্বপ্নের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল।

ফ্রেশ হয়ে কিচেনে ব্রেকফাস্ট বানাবার সময় কিম আর বুন দুজনই এসে দাঁড়িয়েছে হাতে একটা সাদা পাতা। কিছু বলছে না। কিম ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। বুন কাঁদতে পারে না। চুপ করেছিল। হাতে চিঠিটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। আমার ভিতর ভয় আর উৎকন্ঠা। কি লেখা আছে। কি হতে পারে। চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলাম মাত্র দুই লাইনেই শেষ করেছে। লিখেছে ভাই বোনকে তোকেই দেখতে হবে। বড় বোন না, আমি যাচ্ছি , বলতে পারিস পালিয়ে যাচ্ছি। চিঠিটি লিখে রেখে বাবা খুব সন্তর্পণে বেরিয়ে গেছে। তার পরদিন ফিলিপসের সঙ্গে দেখা করে সবটুকু বলেছিলাম। আর বলেছিলাম এই মুহুর্তে আমার কি করা উচিত তুমি বলে দাও। অপেক্ষা করা, না আমাদের এই পথ চলার পরিসমাপ্তি কোনটা। ফিলিপস কিছুই উত্তর দিতে পারেনি। সেই মুহুর্তে একটা কাজের প্রয়োজন ছিল। ভাগ্য হয়ত এই জায়গায় সুপ্রসন্ন ছিল। মিশনারি স্কুলের চাকরিটা হয়ে গেছিল। পুরো সংসারে জড়িয়ে পড়লাম। ভাই বোনকে নিয়ে তিন জনের সংসার। ফিলিপসকে বলেছিলাম তুমি সংসার জীবন শুরু করো। কার্ডিফে চলে যাও। সেদিনে ও কিছু বলেনি। তারপর কিছুদিন দেখা হত কিছু কথাবার্তাও হত ওইটুকুই ব্যাস। তারপর একদিন ফিলিপস জানিয়ে দিল আমি কার্ডিফ যাচ্ছি। অক্সফোর্ডে সোসিওলজি নিয়ে পিএইচডি করতে চাই। এই সব ভাবতে ভাবতেই অ্যানা ঘুমের গভীরে ঢুকে যায়।

কথা মত লাঞ্চের আগেই এলিয়া এসে পৌঁছল। এসেই গ্রান্ডমা মানে অ্যানা বার্নসকে জড়িয়ে ধরল। উজ্জ্বল মুখের এলিয়াকে স্পেনের রাজকন্যার মত মনে হচ্ছে। ক্রিসমাসের কিছু গিফ্ট এনেছিল। ম্যাডাম কারির হাতে দিয়ে বলল ঠিক করে রেখে দাও। এক হাতে ল্যাগেজl  নিয়ে অন্য হাতে ওর গ্রান্ডমাকে ধরে ঘরে নিয়ে যায়।

তখন লাঞ্চ টেবিলে, খেতে খেতে এলিয়া বলল তোমার উপন্যাস নিয়ে দারুণ আলোচনা চলছে। কার্ডিফেও শোনা যাচ্ছে। এবার বুকারে তোমার নাম থাকতেই পারে। তারপর সহজাত স্বতষ্ফুর্ত ভঙ্গিতে বলল জানো আমার আন্ডারে এক সিনিওর অ্যালজাইমার রোগ নিয়ে এডমিড হয়েছে। কাউন্সিলিং করছি। ভাবতে পারছি না এই বয়সে মানে এইটটি ফাইভ হবে কি সুন্দর হারমোনিকা বাজাতে পারে। জন লেননের একটা গান “হ্যাপি ক্রিসমাস, ওয়ার ইজ ওভার” গানটা গাইল আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। আর দেখ নিজের নামটাও ভুলে গেছে। আর একটা জিনিস তোমার বইটা সব সময় নিজের কাছে রেখে দেয়। এই বয়সেও কী সপ্রতিভ। অ্যানা জানতে চাইল কি নাম ওনার। এলিয়া উত্তর দিল ফিলিপস ইয়ং।। কথাটা শেষ করেই বলল আচ্ছা গ্রান্ডমা একটা কথা বলবে তোমার এই উপন্যাসটা কি সত্যিই তোমারই জীবন চরিত। অ্যানা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল আমায় নিয়ে যাবে এলিয়া তোমার হাসপাতালে তোমার ওই অ্যালজাইমার পেশেন্ট ফিলিপসকে দেখব। আর যদি পারো কালকেই। যাবে এলিয়া যাবে। এলিয়া দেখতে পেল গ্রান্ডমার চোখে জল। কেন বুঝতে পারল না চেয়ে রইল। লাঞ্চ টেবিলে দুজনাই বসে রইল মুখোমুখি।

 

( প্রসঙ্গত বুকারজয়ী অ্যানা বার্নস এর সঙ্গে আমার গল্পের অ্যানা বার্নস এর কোন সম্পর্ক নেই। আমার গল্পের সাথে চরিত্রটিও কাল্পনিক  )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − 2 =