প্রতিবাদী

সমীর ঘোষ

হাওড়া-কসবা-রথতলা মিনিবাস। ধর্মতলা থেকে লেনিন সরণী হয়ে মৌলালী ছুঁয়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড ধরে সোজা পার্ক সার্কাস যাবে। তারপর কসবা। ঝামেলাটা ধর্মতলাতেই বাঁধল।ঠাসাঠাসি ভিড় বাসে হঠাৎ এক যুবক কন্ডাক্টরের কাছ থেকে পয়সা চেয়ে বসল। বলল, আমি ২০ টাকাদিয়েছি – টিকিট আর পয়সা ফেরত দাও।
কন্ডাক্টর উল্টে প্রশ্ন করল – আপনি কখন ভাড়া দিলেন?
যুবকটি বলল – এই তো একটু আগেই তো দিলাম
কন্ডাক্টর বলল – আমি কোন টাকাই পাইনি
হঠাৎ বাসের মধ্যে কন্ডাক্টরের সঙ্গে বচসায় যাত্রীদের কান একটু সজাগ হয়ে উঠল। কেউকেউ ভিড়ের মধ্যেই উঁকিঝুঁকি মারতে চেষ্টা করল। আমি জানালার ধারে সিট পেয়েছি। অফিস টাইমেসেরা বাজি। আমার পাশেই এক সুন্দরী। মাঝেমধ্যে বাসের ঝাঁকুনিতে তাঁর শরীরের স্পর্শ পাচ্ছি।এমন অবস্থায় নড়াচড়ার কোন মানে হয় না। আর এসব ঝামেলাতে ঢোকারই বা দরকার কি?
দাঁড়িয়ে থাকা এক প্যাসেঞ্জার বলল – শালারা এইভাবেই পয়সা মারে। পকেটে পুরে নিয়ে বলছে টাকাই পাইনি।
দু’ঘা পড়লেই সব বেরিয়ে যাবে – আর একজন টোন কাটল।
আর বলবেন না, পুরো বাসটাই তো ওদের দখলে। কখনও জোরে চালানো যাবে না বলবে, আবার কখনও টাকা পাইনি বলবে – সঙ্গত দিলেন বয়স্ক চেকশার্ট।
এদিকে কথা কাটাকাটি বাড়ছেই। যুবকটি ভদ্রতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলল – এই শালা একদম মিথ্যে বলবি না।
কন্ডাক্টর বলল – আপনিই তো মিথ্যে কথা বলছেন।
এইভাবে একের পিঠে একজন কথা বলতে বলতে যুবকটি কন্ডাক্টরের বাপ-মা তুলে গালাগাল দিতে লাগল। বলল মৌলালি এলে দেখে নেব।
এক বুড়ো প্রতিবাদ করতেই আরও একধাপ এগিয়ে তেড়ে গেল ওই যুবক। বলল, আপনি দেখেছেন পুরো ঘটনাটা?
বুড়োটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল – না তো বাবা, তাহলে চুপচাপ বসে থাকুন। কোনও কথা বলবেন না। যুবকটি ধমক দিল।
যে প্রতিবাদ করছে করুক, আমার এতে কোনও কাজ নেই। আমি দিব্যি জানালার ধারে বসে আছি। এদিকে ঝামেলাটা ক্রমশ বাড়ছেই। পাশের সুন্দরীও উসখুশ করছে।
এই করতে করতেই মৌলালি চলে এল। নিজের নামার জায়গা আসতেই যুবকটি কন্ডাক্টরকে মারধোর শুরু করে দিল। কিল, চড়, ঘুসি মারতে মারতে বলল – দেখি এইবার কোন শালা বাঁচায় তোকে? উত্তেজনার বহর দেখে ড্রাইভার বাস থামিয়ে দিয়েছে। যুবকটি কন্ডাক্টরকে মারতে মারতে রাস্তায় নামিয়ে ফেলেছে।
আমার পাশের সুন্দরী হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল এসব কি হচ্ছেটা কি! একটা কিছু করুন।
অবশেষে হেল্পার, ড্রাইভার আর কয়েকজন পথচারীর চেষ্টায় মারপিট থামিয়ে মাসে তুলে আনা হল কন্ডাক্টরকে। বাস ততক্ষণে কিছুটা ফাঁকা। গাড়ি আবার চলতে শুরু করতেই প্রতিবাদের ঝড় উঠল গোটা বাস জুড়ে। পিছনের একজন সোচ্চার হল – দেখলেন কিভাবে গুন্ডাগিরি করল।
এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা আওয়াজ তুললেন – বেচার কান্ডাক্টরকে শুধু শুধুই মারল। ছেলেটাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ ছিল।

আর কি বলবেন – এরাই তো চালাচ্ছে সব, কাউকে কিচ্ছু বলার নেই। উত্তর এল পিছনের দিক থেকে। আমার সামনের সিটের টাকমাথা বলে উঠলেন – বলার নেই মানে? এসব মানুষ দীর্ঘদিন মেনে নেবে না – দিনবদল একদিন হবেই।
হঠাৎই সুন্দরী উঠে দাঁড়াল। মুখে একরাশ বিরক্তি। বোধহয় স্টপেজ আসার আগেই নেমে যাবে।
এসব প্রতিবাদের মাঝে নির্বিবাদী আমিও মুখ না খুলে থাকতে পারলাম না। বললাম – আমাদের এলাকায় এসব হলে দেখতেন, লোকটার কি করতাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − eight =