বাঙালির গান (পর্ব ৭)

পার্থসারথি সরকার ##

বৈষ্ণব পদাবলী:

‘রামায়ণ’ ‘মহাভারতে’ পদ অর্থে গানকে বোঝানো হয়েছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে পুরাণে এবং দ্বিতীয় শতকে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে ‘পদ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভরত সংগীতকে ‘গান্ধর্ব’ বলেছেন এবং সেই গান্ধর্বকলার পরিচয় দিতে গিয়ে ‘পদ’ শব্দটি এনেছেন। সেখানে এই শব্দটি ‘বাক্য’ ও ‘সংগীত’ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। কালিদাসের মেঘদূতের ‘উত্তরমেঘ’-এর ২৫ নম্বর শ্লোকে ‘পদ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে ‘পদ’ সংগীত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ‘মেঘদূতে’ আছে—

“উৎসঙ্গে বা মলিন-বসনে সৌম্যে! নিক্ষিপ্য বীণাং/ মদ্‌গোত্রাঙ্কং বিরিচিতপদং গেয়মুদ্‌গাতুকামা।

 তন্ত্রীমার্দ্রাং নয়ন-সলিলৈঃ সারয়িত্বা কথঞ্চিদ্‌/ ভূয়োভূয়ঃ স্বয়মপি কৃতাং মূর্চ্ছানাং বিস্মরন্তী।।”১১

অর্থাৎ, হে সৌম্য মেঘ! আমার মলিনবসনা প্রিয়া কোলে বীণা রেখে গোত্রাঙ্কচিহ্নিত আমার রচিত গান গাইতে চাইছে, কিন্তু তার চোখের জলে বীণার তারগুলি ভেজা, তাই অশ্রু মুছে বারবার নিজ গীতমুর্ছনাও ভুলে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থের মধ্যে সংগীত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে যে সংগীতের ছয় অঙ্গ—স্বর, বিরুদ, পদ, তেন, পাঠ ও তাল। এখানে ‘পদ’—যা  অর্থ প্রকাশ করে-সুতরাং সংগীতের সমগ্র অংশকেও পদ বলা যায়। ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্য্যাপদের সম্পাদনাকালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের নাম দেন ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা’। চর্য্যাপদের মুনিদত্ত কর্তৃক সংস্কৃত ‘নির্মলগিরা’ টীকায় ‘ধ্রুবপদেন দৃঢ়ীকুর্ব্বন্নাহ’, ‘দ্বিতীয় পদেন’, ‘চতুর্থ পদামহ’ ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং হাজার বছর আগেও যে পদ শব্দটি প্রচলিত ছিল তার সাহিত্যিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে পদ অর্থে গানের পংত্তি বা ছত্রকে বোঝানো হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণলীলা বা গৌরলীলাতেও শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলারসের গান পদসংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত হরা হত। ড. সুকুমার সেনের মত অনুসরণ করে বলা যায় যে, আগে পদ বলতে দুই ছত্রের গান বোঝাত।  গানের দুই ছত্রকে ধ্রুবপদ হিসাবে চিহ্নিত করা হত। বৈষ্ণব গীতিকবিতা অর্থে পদ বোঝানো শুরু হয় অষ্টাদশ শতক থেকে। জয়দেবই প্রথম গান অর্থে পদ বা পদসমষ্টিকে বুঝিয়েছেন। তাঁর ‘গীতগোবন্দে’র মধ্যে আছে—“যদি হরিস্মরণে সরসং মনো/ যদি বিলাসকলাসু কুতুহলম্‌।/ মধুরকোমলকান্তপদাবলীং/ শৃণু তদা জয়দেবসরস্বতীম্‌”।। ৩।।” জয়দেব থেকেই প্রথম কীর্তনের ধারা শুরু হয়। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ বহুক্ষেত্রে জয়দেবের অনুসরণ পাওয়া যায়। পদবিন্যাস, শ্লোক, ভঙ্গি এমনকি অলংকারের ক্ষেত্রে বহু জায়গাতেই জয়দেবকে বড়ু অনুকরণ করেছিলেন।  উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—‘তনের উপরে হারে/ অতি খিণী রাধা চলিতে না পারে।’ এই পদটি জয়দেবের ‘স্তনবিস্থিতমপি হারমুদারম্‌’ পদের আক্ষরিক অনুবাদ। জয়দেবের এই প্রভাবের সঙ্গেই বিদ্যাপতির মতো কবিদের অনুকরণে পূর্বরাগ, দানলীলা, গোষ্টলীলা, মাথুর, ভাবসম্মিলন ইত্যাদি বিষয়ে পদরচনা শুরু হয়ে যায়। জয়দেব থেকে বাঙালি পেয়েছিল প্রেমের কবিতার চূড়ান্ত আদর্শ। শ্রীচৈতন্যেদেবের আবির্ভাব সেই সূত্র ধরেই এবং বাঙালির কীর্তনে গীতগোবিন্দের অঙ্গীভূত হওয়া শ্রীচৈতন্যের হাত ধরেই।

       বৈষ্ণব পদের গঠনভঙ্গী বহু পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে। সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত গোস্বামীগণ ‘রসমঞ্জরী’, ‘অমরুশতক’, ‘শৃঙ্গারতিলক’, বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে ভাববস্তু গ্রহণ করেছেন, পাশাপাশি ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’, ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’, ‘সুভাষিতাবলী’, ‘পদ্যাবলী’, ‘সুক্তিমুক্তাবলী’, ‘শার্‌ঙ্গধরপদ্ধতি’, ‘সুক্তিরত্নহার’ গ্রন্থগুলির শ্লোকসমূহের তাঁরা নবরূপে বাণীরূপ দিয়েছেন। 

       আনন্দবর্ধনের ‘ধ্বন্যালোকে’ রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক দুটি প্রাচীন শ্লোকের উদ্ধৃতি আছে। ক্ষেমেন্দ্রের ‘দশাবতারচরিতে’ও রাধাকৃষ্ণ-প্রসঙ্গ আছে। লক্ষ্মণসেনের মহাসামন্ত বটুকদাসের পুত্র শ্রীধরদাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক নানা শ্লোক আছে। ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়ে’র মধ্যে রাধাকৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক কিছু পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। রূপ গোস্বামীর পদ্যাবলীতে রাধাকৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক কয়েকটি পদ পাওয়া যায়। ২৮২, ২৮৩, ২৮৪, ২৮৫ সংখ্যক পদকয়টি এ বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করে। এর দুইটি পদ চক্রপাণি এবং হরিহরের রচনা। পদ্গুলির সঙ্গে বৈষ্ণবদাসের ‘পদকল্পতরু’র শ্লোকের কথা মনে আসে। ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়ে’র শ্লোকগুলির সঙ্গে অনায়াসে পদাবলী সাহিত্যের বেশ কিছু পদের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’র শ্লোকগুলি থেকে ভাবসূত্রে প্রাকৃত প্রেম গ্রহণ ক’রে তার বৈষ্ণবীকরণ ঘটেছে এই সমস্ত পদে। প্রাকৃত ভাষায় লেখা ‘গাথা সপ্তশতী’র (গাহাসত্তসঈ) মধ্যে রাই, কানু ও গোপীদের নিয়ে বেশ কিছু প্রসঙ্গ এসেছে, একে রাধাকৃষ্ণের প্রেমানুরাগের কথার প্রাচীন উৎস বলা যেতে পারে। মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণের পর ছয় বৎসর উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম ভারত পরিভ্রমণ করেন। পুরীধামে দীর্ঘ আঠারো বৎসর কাটানোর সময় রাজগুরু কাশী মিশ্রের আবাসবাটী গম্ভীরার গোপন কক্ষে বিদ্যাপতি, চণ্ডিদাস, জয়দেবের গীতি শুনে আনন্দলাভ করতেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে’ এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়—

‘চণ্ডিদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটক-গীতি কর্ণামৃত শ্রীগীত-গোবিন্দ।

স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রিদিনে গায় শুনে পরম আনন্দ।।’

চৈতন্যদেবের এই ধারা অনুসরণ ক’রে বাংলায়  নাম কীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লীলাকীর্তন বা রসকীর্তনের অনুষ্ঠানের প্রবর্তন ঘটে। এর সূচনা নবদ্বীপ ও শান্তিপুরে এবং প্রবর্ধন খেতুরী-উৎসবে (১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দ)।

       ‘শ্রীমদ্ভাগবত’ ও ‘বিষ্ণুপুরাণে’ কীর্তনের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভগবানের নাম, গুণ, লীলা উচ্চস্বরে উচ্চারণই কীর্তন। বঙ্গে বহুজনের একসঙ্গে গাওয়া ঈশ্বরের লীলার গীতকেই কীর্তন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। রূপগোস্বামীর ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ অনুসারে ‘নামলীলাগুণাদীনাং উচ্চৈর্ভাষা তু কীর্ত্তনম্‌।’ কীর্ত্তন প্রধানত দুই প্রকার—‘নামকীর্তন’ এবং ‘লীলাকীর্তন’। এছাড়াও ‘শোচক-কীর্তন আছে। লীলাকীর্তন বলতে ঈশ্বরের মহিমাময় গীত ও লীলাকথার বর্ণনাকে বোঝায়। অন্যদিকে সত্যযুগে ধ্যানে, ত্রেতায় যজ্ঞে, দ্বাপরে এবং কলিতে হরিকীর্তনে হরির আরাধনা করতে হবে, এটাই নামকীর্তন। বৃন্দাবনদাসের ‘শ্রীচৈতন্য ভাগবতে’ ‘মঙ্গলচণ্ডীর গানের’ উল্লেখ পাওয়া যায়। যোগিপাল, ভোগিপাল মহিপালের গানের কথাও পাওয়া যায়। যেমন ‘যোগিপাল ভোগিপাল মহিপালের গীত, ইহা শুনি সর্বলোক আনন্দিত’। মঙ্গলগানে আংশিকভাবে এবং কীর্তন গানে অনেকখানি এই রাগ তালের মধ্যে অনেকগুলি এখনও ব্যবহৃত হয়। জয়দেব অনুসরণে বিদ্যাপতি এবং চণ্ডিদাসের পদ সুর সংযোগে গীত হতে থাকল। বিদ্যাপতি মৈথিলি ভাষার কবি। মৈথিলি ভাষা বঙ্গে স্থানীয় ভাষার সঙ্গে মিলিত হল, সঙ্গে এলো ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষার প্রভাব—তৈরী হল নতুন কাব্যভাষা—ব্রজবুলি। যাকে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক উপভাষা হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে—ব্রজবুলি। ব্রজবুলি হল সর্বভারতীয় কনিষ্ঠতম আর্য সাধুভাষা। খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত আর্য ভাষাভাষীদের মধ্যে আর্যাবর্তের কথ্যভাষার সার্বভৌম সাধুরূপকে আশ্রয় ক’রে যে সাহিত্য রচনার ভাষা প্রচলিত ছিল তা অবহট্‌টা। পরবর্তীতে পূর্বপ্রদেশের প্রত্যেক প্রদেশে ব্রজবুলির উৎপত্তি হয়।

       সমগ্র ভারতবর্ষেই কীর্তন-জাতীয় গানের প্রচলন ছিল। দাক্ষিণাত্যে আলোয়ার বা আড়বার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে কীর্তনের প্রচলন ছিল। মহারাষ্ট্রে রাবকরি সম্প্রদায়ের মধ্যেও এমন নিদর্শন দুর্লভ নয়। অসমে শঙ্করদেবের সম্প্রদায়ের সাধনমার্গের অঙ্গ হিসাবে কীর্তন অপরিহার্য ছিল। বঙ্গে সম্মেলন গানের প্রচলন ছিল বহু আগের থেকেই। বজ্রযান, সহজযান সম্পর্কিত অধ্যাত্ম সংগীত, নাথযোগী ও অন্যান্য গুহ্য সম্প্রদায়ের সাধনসংগীতও বাংলা প্রাচীন গানের এমনই কিছু দৃষ্টান্ত। 

       কীর্তন কি সে বিষয়ে মোটামুটি ধারণা স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর শিষ্যগণকে যা দিয়ে গিয়েছেন–

“শিষ্যগণ বলেন,–“কেমন সঙ্কীর্ত্তন?”

আপনে শিখায়েন প্রভু শ্রীশচীনন্দন।। ৪০৬।।

(কেদার রাগ)

“(হরে) হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ।

গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন।।” ৪০৭।।

দিশা দেখাইয়া প্রভু হাতে তালি দিয়া।

আপনে কীর্ত্তন করে শিষ্যগণ লৈয়া।। ৪০৮।।”১৩

 ‘চৈতন্যভাগবত’-অনুযায়ী শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে শ্রীনিত্যানন্দকেও সংকীর্তনের অগ্রদূত হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এ প্রসঙ্গে বৃন্দাবনদাস বলেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কীর্তনের জনক বা শ্রষ্টা; তাঁরা ‘সংকীর্তনকপিতরৌ’ ‘কলিযুগের সর্বধর্ম হরিসংকীর্তন/ প্রকাশিলেন চৈতন্য নারায়ণ’ হলেও নিত্যানন্দকে অস্বীকার করার উপায় নেই। শ্রীপাদ নিত্যানন্দ শ্রীচৈতন্য-উপাসনার সঙ্গে শ্রীচৈতন্য-সংকীর্তনেরও সূচনা করেন, যা আজকের দিনেও বৈষ্ণব টহল-কীর্তনিয়াদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় পরম মমতায়, প্রভাতী রাগে—

‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে।

যে জন গৌরাঙ্গ ভজে সে হয় আমার প্রাণ রে।।’

শ্রীপাদ নিত্যানন্দ ছিলেন সমাজের রীতিনীতি-ভাঙ্গা, অন্ধসংস্কার-বিরোধী একজন প্রগতি মনঙ্ক মানুষ। শ্রীচৈতন্য-পার্ষদ মুকুন্দ, গোবিন্দ-বাসু-মাধব ঘোষ ভ্রাতৃত্রয় কীর্তন গান করতেন। পুরীতে স্বরূপ দামোদর, রায় রামানন্দ, ছোট হরিদাস কীর্তন করতেন। এখানে ভাগবত পাঠ করতেন পণ্ডিত গদাধর গোস্বামী—যা পরবর্তীতে কথকথা ক্রমে কীর্তনের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। 

শ্রীচৈতন্য-শ্রীনিত্যানন্দ-শ্রীঅদ্বৈতের পরে বৈষ্ণব সংগীতের পরম্পরা রক্ষার ভার গিয়ে পড়ে শ্রীনিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের উপর। বীরভদ্রের পরবর্তীতে এই ভার গ্রহণ করেন গোপাল ভট্টের শিষ্য শ্রীনিবাস আচার্য, লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্য নরোত্তম ঠাকুর এবং হৃদয় চৈতন্যের শিষ্য শ্যামানন্দ প্রভু। শ্রীবৃন্দাবনে যে সংগীতের চর্চা চলছিল, তার অন্যতম সংগীতসাধক ছিলেন শ্রীহরিদাস গোস্বামী। নরোত্তম বৃন্দাবন থেকে জন্মভূমি দর্শন করতে এসে  পিতৃব্য সন্তোষের অনুরোধে খেতরীতে কুটীর বেঁধে বাস করতে শুরু করেন। পাঁচ মহাপ্রভু বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে তিনি খেতরীতে বৈষ্ণব সম্মেলনের অনুষ্ঠান করেন ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে। এই উৎসবের অধীনেত্রী ছিলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর দ্বিতীয়া পত্নী শ্রীজাহ্নবা দেবী। এই সম্মেলনেই নরোত্তম কীর্তন গানে রসকীর্তন-পদ্ধতির প্রবর্ত্তন করেন। এখানেই প্রণালীবদ্ধভাবে ‘গৌরচন্দ্রিকা’-গানের পর লীলাকীর্তন গানের প্রথার প্রচলন ঘটে। এখানেই নরোত্তম একটি সুশিক্ষিত গায়ক-বাদক সম্প্রদায় নিয়ে যে সুরে রসকীর্তন গান করেছিলেন, তা পরে গড়েরহাটি বা গড়ানহাটি নামে পরিচিত হয়। আসলে খেতরী রাজশাহীর গড়েরহাট পরগণার অন্তর্ভুক্ত বলে এই সুরের এইরকম নামকরণ হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী তাঁর প্রধান দুই মাদলবাদক শ্রীগৌরাঙ্গদাস ও শ্রীদেবীদাস এবং প্রধান দুই দোহার গায়ক শ্রীদাস ও গোকুলানন্দ পুরীধামে শ্রীপাদ স্বরূপ দামোদকের কাছ থেকে সংগীত শিক্ষা ক’রে আসেন। বর্তমানে প্রণব আচার্য মনে করেন  গরাণহাটী বা গড়ের হাট বর্তমান বাংলাদেশের রাজসাহী পরগণার গরাণহাটি পরগণার নামানুসারে হয়েছে। গড়েরহাটীর লয় বিলম্বিত, ছন্দ দীর্ঘ হয় মাত্রা সারল্য এবং প্রসাদগুণযুক্ত হয়ে থাকে। এই রীতিতে তালের সংখ্যা একশ আট। শাস্ত্রীয় সংগীতের নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ সংগীত বিশুদ্ধ রাগে আধারিত গরাণহাটী কীর্তনে। এটি ধ্রুপদাঙ্গ কীর্তন। লোকায়ত গায়কি এবং সুর এতে বর্জনীয়।

সংগীতের পীঠভূমি রাঢ়দেশে সংগীতশিক্ষার বহু পীঠস্থান ছিল। এই সংগীতকেন্দ্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বীরভূমের অন্তর্গত শ্রীখণ্ড, কান্দরা এবং ময়নাডাল। পরবর্তীতে শ্রীখণ্ড ও কান্দরা বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়। খেতরী থেকে ফিরে জ্ঞানদাস ও মনোহরদাস, কান্দরার বনন, শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দন এবং ময়নাডালের নৃসিংহ মিত্র ঠাকুরকে নিয়ে রাঢ়ের প্রচলিত সঙ্গীতধারার সংস্কার সাধন করেন। কান্দরা মনোহরশাহী পরগণার অন্তর্ভুক্ত বলে এই ধারা ‘মনোহরসাহী কীর্তন’ নামে পরিচিত হয়। মনোহরসাহীর ক্ষেত্রে দেখা যায় এর লয় এবং ছন্দ গড়েরহাটী অপেক্ষা সংক্ষিপ্ত হয়। এখানে সুরের নানা কারিগরী এবং মাত্রার জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। এটি খেয়ালাঙ্গ গান। এটি চুয়ান্ন তালের গান। অন্য মতে মুর্শিদাবাদ কিরীটকোনা গ্রামের বংশীবদন ঠাকুর সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং বর্ধমানের কাঁদড়াতে আশ্রম স্থাপন করেন। বংশীবদন কীর্তন শেখেন আউলিয়া মনোহর দাসের কাছে। তিনি গরানহাটী কীর্তনধারার সঙ্গে খেয়ালাঙ্গ রীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে এই কীর্তনের উদ্ভব ঘটান। তাই মনোহরশাহী কীর্তনের সঙ্গে খেয়ালের তুলনা চলে। প্রবন্ধগানের দৃঢ় বাঁধনের মধ্যেও ছুট, কথা, আখর, তুক ইত্যাদির ব্যবহার মনোহরশাহীকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে।

বর্ধমানের সাতগাছিয়া থানার অন্তর্গত ক্ষুদ্র গ্রাম রেনেটী রাণীহাটী পরগণার অন্তর্গত। এখানকার দেবীপুরের বিপ্রদাস ঘোষের দ্বারা প্রবর্তিত কীর্তনের একটি সুরের নাম হয় ‘রেনেটী’। গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধানে শ্রীহরিদাস দাস অবশ্য রেনেটীর রূপকার হিসাবে গোকুলানন্দ সেনকে উল্লেখ করেছেন। সর্বজনগ্রাহ্য মত বৈষ্ণবদাস ও উদ্ধবদাস এই ধারাকে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ করেন। ছাব্বিশ তালের এই রেনেটীর মাধুর্য কোনও অংশে মনোহরশাহী থেকে কম নয়। সৌন্দর্য ও মিষ্টত্বের দিক থেকে এর আবেদন ছিল। সহজ ও সরস ভাবের জন্য থেকে অনেকে ঠুংরীর সঙ্গে তুলনা করেন। পূর্বোক্ত ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান’ মতে রেনেটীর প্রবর্তক মেদিণীপুরের শ্যামানন্দ প্রভু।  কীর্তনের আরো দুটি প্রকার আছে, এর একটি মন্দারিনী এবং অন্যটি ঝাড়খণ্ডী। মধ্যযুগের মেদিনীপুরের সরকার মন্দারণের নামে মন্দারিনী নামকরণ হয়। এই সুর রাঢ়ের মঙ্গলকাব্যের সুর। এ ধারা বর্তমানে প্রায় লুপ্ত। অনেকে এই ধারার প্রবর্তক হিসাবে বংশীবদন ঠকুরকে মনে করেন। মন্দারণ নিয়ে মতভেদ আছ। অনেকের মতে এই গড় মন্দারণ হুগলী জেলায় আরামবাগের কাছে অবস্থিত।

ঝাড়খণ্ডীও রাঢ়ের একটি প্রাচীন সুর। এতে ঝুমুরের প্রভাব আছে। বর্তমানে পুরুলিয়ার শিখরভূমের সেরগড় থেকে ঝাড়খণ্ডী থাটের উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গলে’ এই সুরের সন্ধান মেলে—যা ত্রিপদী-আশ্রিত। কবীন্দ্র গোকুল এই সুরের সংস্কার সাধন করেন, তবে এই ধারাটি বর্তমানে লুপ্ত।

       কীর্তনের পাঁচ অঙ্গ—কথা, দোঁহা, আখর, তুক ও ছুট। কথা বলতে এক গান থেকে অন্য গানের যোগসূত্র, গানের কোন একটি পংক্তির অর্থ যেটি গায়ক কথার মাধ্যমে ব্যখ্যা করেন কীর্তনে তাকেই কথা বলে। দোঁহা শব্দে বোঝায় উভয়—দুই পাশের গাইবার সঙ্গী। যে কারণে এঁদেরকে দোহার বলা হয়। মূল গায়কের গাইবার পর দুই হার বা দোহার গানের সূত্র ধরিয়ে দেন, সহায়তা করেন এবং গানের সুরের রেশ জমিয়ে রাখেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃতের’ দুই এক চরণ, বিশেষভাবে মান্য কোন গ্রন্থের শ্লোকাংশ কীর্তনে দোঁহা নামে পরিচিত। গায়নকালে হিন্দি চৌপাই, দোঁহা বা শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত সংস্কৃত শ্লোকসমূহকে দোঁহা বলা হয়। আখর কীর্তন শুনে বুঝে নিতে হয়। আখর তাৎক্ষণিক রচনা। রবীন্দ্রনাথ একে ‘কথার তান’ বলেছেন। এর মধ্যে দিয়ে কীর্তনের ভাবাবেগ প্রকাশিত হয়ে থাকে। খেয়ালের বোল বিস্তার, বহুলবাও-র মতো কিছুটা হল আখর। কীর্তনের সর্বশ্রেষ্ট বৈশিষ্ট্য আখর। অনুপ্রাসবহুল ছন্দোময়, মিলনাত্মক গাথাকে তুক নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ছন্দ বৈচিত্র্যের জন্য অনুপ্রাস বা আখরের সঙ্গে পদের বা পদ্যের আখরকে জুড়ে কীর্তনীয়ারা সৃষ্টি করেন। ‘তুক্‌’ গুরু পরম্পরায় সৃষ্ট। কেউ কেউ তুক্‌কে ‘তুক্ক’ও বলেন। ‘ছুট’ বলতে তালকে বোঝায়। ছোট ছোট তালে দ্রুত লয়ে গাওয়া বৈচিত্র্যবর্ধনকারী পদের কিছু অংশকে ছুট বলে। ঠুংরীর লগ্‌গী অঙ্গে ‘বোল-বানানার’ সঙ্গে ছুটের কিছুটা মিল আছে। পূর্বোক্ত ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান’ অনুসারে কীর্তনের ছয়টি উপাঙ্গ। এতে ষষ্ঠ উপাঙ্গটি হল ঝুমুর। ঝুমুর বলতে বোঝায় পালাকীর্তনের উপসংহারে গেয় হালকা চালের নৃত্যাশ্রয়ী সুর। কীর্তনের রীতি হল মিলন গেয় পালা সমাপ্ত করা। দু-চারটি পয়ার, ত্রিপদীর মাধ্যমেই মিলন সূচিত হয়। ঝুমুর এই মিলনাত্মক রীতির প্রতিনিধিত্ব করে।

রূপ গোস্বামী ‘ঊজ্জ্বলনীলমণি’তে বৈষ্ণব অলংকারশাস্ত্রকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন—নায়ক-নায়িকাপ্রকরণ, রসতত্ত্ব ও শৃঙ্গারভেদ। পরবর্তীতে এই আদর্শই পদাবলীতে গৃহীত হয়েছে। এই গ্রন্থ অনুযায়ী রস ও লীলাপর্যায়গুলি হল—১। নায়কভেদ, ২। সহায়ভেদ, ৩। কৃষ্ণবল্লভা, ৪। রাধাপ্রকরণ, ৫। নায়িকাভেদ, ৬। যূথেশ্বরী ভেদ, ৭। দূতীভেদ, ৮। সখীপ্রকরণ, ৯। হরিবল্লভাপ্রকরণ, ১০। উদ্দীপনপ্রকরণ, ১১। অনুভবপ্রকরণ, ১২। উদ্ভাস্বরপ্রকরণ, ১৩। সাত্ত্বিকপ্রকরণ, ১৪। ব্যভিচারিভাব, ১৫। স্থায়িভাব ও ১৬। শৃঙ্গারভেদ। লীলাকীর্তন বা রস-কীর্তন চৌষট্টি রসের গান। উজ্জ্বল বা শৃঙ্গার রস দুই ভাগে বিভক্ত—‘বিপ্রলম্ভ’ ও ‘সম্ভোগ’। অনুরক্ত যুবক-যুবতী মিলনোৎসুক, কিন্তু তাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হচ্ছে না, একে ‘বিপ্রলম্ভ’ বা ‘বিরহ’ বলে আর নায়ক-নায়িকার মিলনে যে উল্লাস তাকেই ‘সম্ভোগ’ বলে। বিপ্রলম্ভের চার ভাগ—পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্ত্য এবং প্রবাস বা মাথুর। সম্ভোগের চারভাগ—সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ, সংকীর্ণ সম্ভোগ, সম্পন্ন সম্ভোগ ও সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ। এই আটটি রস, প্রত্যেকটির আটটি করে মোট চৌষট্টি রস।

বিপ্রলম্ভ রসের শ্রেণিবিভাগ—

পূর্বরাগ দু প্রকার—দর্শনজাত ও শ্রবণজাত— (শ্রীকৃষ্ণকে) সাক্ষাতে দর্শন, চিত্রপটে দর্শন, স্বপ্নে দর্শন, ভাটমুখে শ্রবণ, দূতিমূখে শ্রবণ, দূতিমূখে শ্রবণ, সখীমুখে শ্রবণ, গুণীজনের গানে শ্রবণ, বংশীধ্বনি শ্রবণ ইত্যাদি।

মান দ্বিবিধ—সহেতুক ও অহেতুক— (শ্রীকৃষ্ণের অপরাধের কথা) সখীমুখে শ্রবণ, শুকমুখে শ্রবণ, শ্রীকৃষ্ণের মুরলীধ্বনিতে অন্য নায়িকার নামের আভাস, শ্রীকৃষ্ণের দেহে রাধিকা ভিন্ন অন্য গোপীর ভোগচিহ্ন দর্শন, প্রতিপক্ষ নায়িকার অঙ্গে ভোগ চিহ্ন দর্শন, গোত্রস্খলন, স্বপ্নে অন্য নায়িকার সঙ্গে দর্শন, সাক্ষাতে অন্য নায়িকার সঙ্গে দর্শন ইত্যাদি। 

প্রেম-বৈচিত্ত্য— শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আক্ষেপ, মুরলীর প্রতি, নিজের প্রতি, সখীর প্রতি, দূতীর প্রতি, বিধাতার প্রতি, কন্দর্পের প্রতি, গুরুজনের প্রতি আক্ষেপ। এতে প্রিয়ের সন্নিকটে থেকেও মানসিক দূরত্বের অনুভব হয়।

প্রবাস—(নিকট প্রবাস) কালীয় দমন, গো-চারণ, নন্দমোক্ষণ, কার্য্যানুরোধে, রাসে অন্তর্ধানে সাময়িক অদর্শনজনিত বিরহ। (দূর প্রবাস) ভাবী এবং মথুরা গমন ও দ্বারকা গমন ভবন্‌ বিরহ।

সম্ভোগের শ্রেণিবিভাগ—

সংক্ষিপ্ত—বাল্যাবস্থায় চুম্বন, গোষ্ঠে মিলন, গোষ্ঠে গমন, গো-দোহন, আকস্মাৎ চুম্বন, হস্তাকর্ষণ, বস্ত্রাকর্ষণ, রতি ভোগ।

সংকীর্ণ—মহারাস, জলক্রীড়া, কুঞ্জলীলা, দানলীলা, বংশীচুরি, নৌকাবিলাস, মধুপান, সূর্য্যপূজা ইত্যাদি।

সম্পন্ন—সুদূর দর্শন, ঝুলন, হোলি, প্রহেলিকা, পাশাখেলা, নর্ত্তকরাস, রসালস, কপটনিদ্রা।

সমৃদ্ধিমান—স্বপ্নে বিলাস, কুরুক্ষেত্র মিলন, ভাবোল্লাস, ব্রজাগমন, বিপরীত সম্ভোগ, ভোজন কৌতুক, একত্র নিদ্রা, স্বাধীনভর্তৃকা।

বৈষ্ণব রসশাস্ত্রকারেরা বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নায়িকার আট প্রকারের রসের বর্ণনা দিয়েছেন, এই আটটি নায়িকা প্রকার হল—১। অভিসারিকা, ২। বাসকসজ্জিকা, ৩। উৎকন্ঠিতা, ৪। বিপ্রলব্ধা, ৫। খণ্ডিতা, ৬। কলহান্তরিতা, ৭। প্রোষিত-ভর্ত্তৃকা ও ৮। স্বাধীন-ভর্ত্তৃকা।

১। অভিসারিকা—এক্ষেত্রে নায়িকা নিজে অভিসার করেন বা নায়ককে অভিসার করান। এটি আটটি ভাগে বিভক্ত। যথা—জোৎস্নাভিসারিকা, তমসাভিসারিকা, দিবাভিসারিকা, বর্ষাভিসারিকা, কুজ্‌ঝটিকাভিসারিকা, তীর্থযাত্রাভিসারিকা, উন্মত্তাভিসারিকা ও অসমঞ্জস্যাভিসারিকা।

২। বাসকসজ্জিকা—এই নায়িকা প্রিয়তম নিজ অবসরে আসবেন ভেবে বাসগৃহ এবং নিজদেহ সুসজ্জিত করেন তিনি। এটি আটটি ভাগে বিভক্ত। যথা—মোহিনী, জাগ্রতিকা, রোদিতা, মধ্যোক্তিকা, সুপ্তিকা, চকিতা, সুরসা এবং উদ্দেশা।

৩। উৎকন্ঠিতা—এখানে নায়ককে নিরপরাধ মেনে তার বহুক্ষণ যাবৎ কোনোরকম সংকেত না পেয়ে উৎসুক নায়িকা। এটিও আট প্রকার। যথা—দুর্মতি, বিকলা, স্তব্ধা, উচ্চকিতা, অচেতনা, সুখোৎকণ্ঠিতা, মুখরা এবং নির্বন্ধা।

৪। বিপ্রলব্ধা—সঙ্কেত না ক’রে আসার ফলে খেদযুক্ত নায়িকা হলেন বিপ্রলব্ধা। এর আট প্রকার হল—বিফলা, প্রেমমত্তা, ক্লেশা, বিনীতা, নির্দয়া, প্রখরা, দূত্যদরা ও ভীতা।

৫। খণ্ডিতা—পূর্ব সংকেত থাকা সত্বেও নায়ক অন্য নায়িকার সঙ্গে সম্ভোগের চিহ্নাদি নিয়ে রাত্রি অতিক্রমে দেখা করতে আসায় নায়িকার অবস্থা এটি। খণ্ডিতারও আট প্রকারভেদ। যথা—নিন্দা, ক্রোধা, ভয়ানকা, প্রগলভা, মধ্যা, মুগ্ধা, কম্পিতা ও সন্তপ্তা।

৬। কলহান্তরিতা—ইনি সখীদের সামনে পাদ-পতিত প্রিয়তমকে বাধা দিয়ে পরে অনুতাপ করা নায়িকা। এর শ্রেণিবিভাগ হল—আগ্রহা, ক্ষুব্ধা, ধীরা, অধীরা, কুপিতা, সমা, মৃদুলা এবং বিধুরা।

৭। প্রেষিত-ভর্ত্তৃকা—নায়ক দূরদেশে গেলে সেই নায়িকাকে প্রেষিতভর্ত্তৃকা বলে। এর শ্রেণিবিভাগ হল—ভাবী, ভবন্‌, ভূত, দশ-দশা, দূতসংবাদ, বিলাপ, সখ্যুত্মিকা ও ভাবোল্লাস।

৮। স্বাধীন-ভর্ত্তৃকা—যে নায়িকার অনুগত হয়ে নায়ক সব সময় তাঁর কাছে থাকেন, তাকে স্বাধীন-ভর্ত্তৃকা বলে। একে আটটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা—কোপনা, মালিনী, মুগ্ধা, মধ্যা, সমুত্তিকা, সোল্লাসা, অনুকূলা ও অভিষিক্তা।

নামকীর্তন বা সংকীর্তন, রসকীর্তন বা পালাকীর্তন ছাড়াও অনেকে সূচক বা শোচক কীর্তনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। প্রসিদ্ধ কোন বৈষ্ণব সাধক, বৈষ্ণব মহান্ত বা ভক্তাদির তিরোধান বা তিরোভাব উৎসবে তাঁদের লীলাগাথা বা জীবনকাহিনি বা স্মরণবন্দনা যে কীর্তনের মাধ্যমে হয়ে থাকে, তাকে এই কীর্তনের মধ্য ফেলা হয়।

 মধ্যযুগের সংগীতের ইতিহাস  বিশ্লেষণে পদাবলী যেকোনো দেশের যেকোনো ভাষার সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মধ্যযুগে ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষার বশে বহু কীর্তনীয়া বহুপদ নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন।  কেউ কেউ বহুপদ একত্রিত করে বিরাট সংকলন গ্রন্থ সম্পাদন করেছিলেন।  সপ্তদশ শতকে এমন পদ সংকলন হয়েছিল—বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ‘ক্ষণদাগীতচিন্তামণি’। সাত-আটখানি বৈষ্ণব পদ সংকলন গ্রন্থ অষ্টাদশ  শতকেই সংকলিত হয়েছিল। এখানে ৪৫  কবির  ৩০৯ টি পদ সংকলিত হয়েছে।  বিশ্বনাথ ‘হরিবল্লভ’ ভনিতায় এখানে নিজেই ৫১ টি পদ রচনা করেছেন।  খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকের সূচনায়, সংকলিত অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ছিল শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র রাধামোহন ঠাকুরের ‘পদামৃতসমুদ্র’।  এই সংকলন গ্রন্থের পদের সংখ্যা ৭৬৪ টি।  যার মধ্যে ২২৮ টি স্বয়ং রাধামোহন ঠাকুর রচিত। রাধামোহন ‘মহাভাবাতুসারিণী’ নামে এর একটি সংস্কৃত টীকা লিখেছিলেন। নরহরি-চক্রবর্তী সংকলিত ‘গীতচন্দ্রোদয়’ একটি উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণব পদসংকলন গ্রন্থ।  এখানে পূর্বরাগের পদ সংকলিত ১১৬৯ টি।  বৈষ্ণব পদাবলী সংকলনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পদকল্পতরু’।  এই গ্রন্থের সংকলক ছিলেন গোকুলানন্দ সেন বা বৈষ্ণবদাস।  এই গ্রন্থে সংকলিত পদসংখ্যা ৩১০১ টি।  গৌরসুন্দর দাসের কীর্তনানন্দ গ্রন্থে ১১১৯ টি পদ সংকলিত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দিনবন্ধু দাস সংকলিত ‘সংকীর্তনামৃত’ গ্রন্থে পদের সংখ্যা ছিল ৪৮৯ টি। উনিশ শতকের প্রথমদিকে কমলাকান্ত দাস সংকলন করেন ১৩৫৮ টি পদের।  সংকলিত গ্রন্থটির নাম ছিল ‘পদরত্নাকর’।  নিমানন্দ দাসের ‘পদরসসার’ সঙ্কলনটি ২৭০০ পদের সমাহার। এছাড়াও গৌরমোহন দাস ৩৫০ টি পদ সম্বলিত  ‘পদকল্পলতিকা’,  জগদ্বন্ধু ভদ্রের  ‘গৌরপদতরঙ্গিণী’  ইত্যাদি পরবর্তী যুগের উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণব পদ-সংকলন।  সারদাচরণ মিত্র ও অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সম্পাদনায় ‘প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ’ (১৮৭১),  সারদাচরণ মিত্রের ‘বিদ্যাপতির পদাবলী’ (১২৮৫ বঙ্গাব্দ), রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ‘পদরত্নাবলী’ (১২১৯ বঙ্গাব্দ),  জগদ্বন্ধু ভদ্রের ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’,  রমণীমোহন মল্লিকের ‘চন্ডীদাসের পদসংগ্রহ’ (১৩০৩ বঙ্গাব্দ) উল্লেখযোগ্য।

       ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব পদাবলীকে তিনটি শাখাতে ভাগ করা যায়—যথা চৈতন্য-পূর্ববর্তী পদ ও সাহিত্য,  চৈতন্যজীবৎকালে আবির্ভূত পদকারগণের পদাবলী  এবং চৈতন্যতিরোধান এর পরবর্তীতে আবির্ভূত পদকারগণের পদাবলী। চৈতন্য পূর্ববর্তী প্রজন্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস। মিথিলার দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী মহকুমার বিস্‌ফী গ্রামে চতুর্দশ শতকের শেষভাগে বিদ্যাপতি জন্মগ্রহণ করেন।  বিদ্যাপতি মৈথলী ভাষার কবি হলেও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  বিদ্যাপতির সংস্কৃত ও অবহট্ট ভাষায় রচিত সাহিত্যের মৌলিকত্ব থাকলেও পদাবলী সাহিত্যে তিনি সবকিছুকে অতক্রম ক’রে গেছেন।  বিদ্যাপতির সঙ্গে  বাংলার যোগাযোগ ৪০০ বছরেরও বেশি।  রাধা ও মাধবের স্পষ্ট উল্লেখযুক্ত বিদ্যাপতির পদাবলী সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।  বিদ্যাপতি তাঁর পূর্বরাগ, প্রথম মিলন, বাসকসজ্জা, অভিসার, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা, কলহন্তরিতা, মান, বিরহ, পুনর্মিলনের মধ্যে দিয়ে রাধা কৃষ্ণের বিরহ মিলন বর্ণনা করেছেন।  বিদ্যাপতির পদে রাজসভার বৈদগ্ধ্য আছে।  আক্ষেপ এবং অভিসারের পদে বিদ্যাপতি অসামান্য।  বিদ্যাপতির যুগ থেকেই তাঁর পদাবলী বঙ্গের পরিচিত ছিল এবং তা গীতও হত।  স্বয়ং শ্রীচৈতন্য তাঁর গান  শ্রবণে প্রসন্নতা লাভ করতেন।  বিদ্যাপতির গানে প্রভাবিত হয়েছেন গোবিন্দদাস কবিরাজ।  বৈষ্ণব গান তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল অনেকখানি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাপতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।  বাংলা  চলচ্চিত্রের মধ্যেও বিদ্যাপতির পদসমূহ অত্যন্ত সাবলীল ভাবে গৃহীত হয়েছে  কৃষ্ণচন্দ্র দে, কানন দেবী-দের কন্ঠে।

চৈতন্য-পূর্ববর্তী পদকর্তাদের মধ্যে অনেকেই মূলত জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ এবং ‘ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণ’-এর বিষ্ণুপুরাণ আদর্শ নিয়ে পদ রচনা করেছেন। ‘গীতগোবিন্দে’ যে বৈষ্ণব পদাবলীর সুর, তা  অনুসৃত হয়েছে রায়রামানন্দের ‘জগন্নাথবল্লভ’ নাটক সংস্কৃত  নাটকে রাধার অভিসারের বর্ণনাতে এবং ‘পদ্যাবলী’র রূপ গোস্বামীর শ্লোকে।  গোবিন্দদাস কবিরাজ অনুসরণ করেছিলেন জয়দেব ও বিদ্যাপতিকে—ভাষার শব্দ সম্ভারে ছন্দে ‘গীতগোবিন্দের’ ঝংকারে। প্রচলিত পদাবলীর প্রথম সুর পাওয়া যায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র মধ্যে।  বড়ু চন্ডীদাসের এই কাব্যের শেষ ‘রাধাবিরহ’-এর মধ্যে রাধার বিলাপের আন্তরিকতার মধ্যে সে সুর আছে। শ্রীপ্রমথনাথ বিশীর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যেখানে সমাপ্তি, চৈতন্য যুগের পদাবলীর সেখান হইতে আরম্ভ’ এ-কথা যথার্থই।  মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর মধ্যেও বৈষ্ণব পদাবলীর সুর স্পষ্ট। চৈতন্য যুগের একজন পদাবলী-প্রণেতা ছিলেন যশোরাজ খান।  তিনি কৃষ্ণচরিত কাব্য লিখেছিলেন অনুমেয়।  যশোরাজের পদে বিদ্যাপতির ভাষা ও ভঙ্গিমা এবং গৌড়ীয় মনোভাব লক্ষ্য করার মতো। তাঁর ব্রজবুলিতে লেখা—‘এক পয়োধর চন্দন লেপিত’ পদটি প্রসিদ্ধ।

চন্ডীদাস কয়জন এবং তাদের সময়কাল কী—এই নিয়ে বহু প্রশ্ন তৈরি হলেও একথার মান্যতা দিতে হয় যে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ বড়ু চন্ডীদাস এবং পদাবলীর চন্ডীদাস ভিন্ন ব্যক্তিত্ব।  স্বয়ং মহাপ্রভু যে পদাবলীর বিরুদহীন চন্ডীদাসের  পদাস্বাদন করতেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।  বীরভূমের নান্নুর গ্রামে, মতান্তরে বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে চণ্ডীদাস জন্মগ্রহণ করেন।  চণ্ডীদাস তাঁর পদাবলীতে  যে রাধার চিত্র এঁকেছেন সেখানে তিনি সমস্ত স্থূলতাকে অতি সূক্ষ্ম মিস্টিক আবরণে ঢেকে দিয়েছেন যার তুলনা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আর নেই।  সহজ কথায় সহজ ছন্দে অতিসাধারণ অলংকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তিনি রাধাকে জীবন্ত রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন।  পদাবলীর চন্ডীদাসের পদাবলী বাঙালি মনীষার আবেদনে ধরা দিয়েছে বারবার।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু-প্রশংসা করেছেন।  চন্ডীদাসকে নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র—তাঁর পদও গাওয়া হয়েছে বহু চলচ্চিত্রে। 

       চৈতন্য সমসাময়িক পদকর্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুরারি গুপ্ত।  চৈতন্যের সহচর মুরারি গুপ্তই সর্বপ্রথম সংস্কৃতে চৈতন্য জীবনীকাব্য লেখেন।  বাংলা ও ব্রজবুলিতে লেখা  তাঁর পদগুলি সুখপাঠ্য। শ্রীখন্ড বৈদ্যপুরে আবির্ভূত নরহরি সরকার ছিলেন গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদের অন্যতম আদি রচনাকার।  চৈতন্যদেবের গৌরনাগরী ভাবাশ্রিত পদাবলীর প্রবর্তক ছিলেন তিনি।  শিবানন্দ সেন, বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়রাও বেশ কিছু ভালো বাংলা ও ব্রজবুলি পদ রচনা করেছিলেন।  এছাড়াও গোবিন্দ ঘোষ, মাধব ঘোষ এবং বাসু(দেব) ঘোষ তিন ভাইই ছিলেন শ্রীচৈতন্যের  অনুচর ও পার্ষদ।  এঁরা পদকার ছিলেন তবে, বাসু ঘোষের পদই ছিল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট।  সরল বাংলা ভাষায় বাসু ঘোষ চৈতন্য সন্ন্যাস বিষয়ক যে পদ রচনা করেছেন তার ঐতিহাসিকতা ও কাব্যমূল্য সর্বজন স্বীকৃত।  এঁরা ছাড়া রামানন্দ বসু, যদুনন্দন,  গোবিন্দ আচার্য, বাসুদেব দত্তরাও চৈতন্য-সমসাময়িক ছিলেন। চৈতন্যের পরবর্তীতে ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রেষ্ঠ পদকর্তাদের আবির্ভাব ঘটে।  এঁরা ছিলেন বলরাম দাস,  জ্ঞানদাস,  রায়শেখর,  গোবিন্দ দাস, রায় বসন্ত প্রমুখ।  চৈতন্য-তিরোধানের শোকাবেগ প্রশমিত হ’লে বৈষ্ণব সমাজ এবং সম্প্রদায় শ্রীচৈতন্যকে অবতার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলেন।  চৈতন্য বিগ্রহে সমর্পিতপ্রাণ ভক্ত ও কবির দল নব রসে সিক্ত হয়ে পদাবলীর ঐশ্বর্য রূপ প্রদান করলেন।  

বৈষ্ণব সাহিত্যে একাধিক বলরাম দাসের উপস্থিতি থাকলেও,  প্রাচীনতর বলরামদাসই শ্রেষ্ঠ।  কৃষ্ণনগরের নিকট দোগাছিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  ব্রজবুলি এবং বাংলাতে পদরচনা করলেও তিনি বাংলা ‘রসোদ্‌গার’ ও ‘বাৎসল্য’ পদের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা ছিলেন। তিনি নিত্যানন্দ দ্বারা দিক্ষিত  ছিলেন।  বাৎসল্য রসের পদে তার শ্রেষ্ঠত্ব ছিল অনতিক্রম্য।  তবে আক্ষেপানুরাগের পদে রাধার বেদনাকীর্ণ পদগুলো বেশ উচ্চপর্যায়ের। কাটোয়ার কাছে কাঁদড়া গ্রামের ব্রাহ্মণ  বংশে জ্ঞানদাসের জন্ম হয়। তিনি প্রায় চারশো পদ রচনা করেছিলেন।  বাংলায় লিখিত পদগুলিতে তিনি চন্ডীদাস এবং ব্রজবুলিতে লিখিত পদে বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করেছিলেন।  তাঁর পূর্বরাগ, রূপানুরাগ, দানখন্ড নৌকাখন্ড রসোদগার ইত্যাদি পদ বৈষ্ণব সাহিত্যে অতুলনীয়।  জ্ঞানদাস যথাযথ শিল্পী। গোবিন্দদাস ব্যতীত সে যুগে জ্ঞানদাসের সমতুল্য পদকর্তা কেউ ছিলেন না। গোবিন্দদাসের পিতা ছিলেন পরম চৈতন্যভক্ত চিরঞ্জীব সেন। মাতামহ বিখ্যাত পন্ডিত শাক্ত দামোদর সেন।  তাঁর অগ্রজ ছিলেন রামচন্দ্র কবিরাজ যিনি শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।  গোবিন্দদাসের রচিত বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন বিমানবিহারী মজুমদার করেছেন তাতে পদাবলীর সংখ্যা প্রায় আট শতের কাছাকাছি।  তাঁর ‘সঙ্গীতমাধব’ নাটক পাওয়া যায় না।  ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন।  বিদ্যাপতির স্পষ্ট অনুকরণের জন্য গোবিন্দদাস ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে পরিচিত হন।  গোবিন্দদাসের পদে শব্দঝংকারের বাহুল্য আছে।  এ যুগে যদুনন্দন, মাধবদাস (মাধবাচার্য), অনন্তদাসের মত আরো কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবির আবির্ভাব ঘটেছিল।  এঁদের কেউ কেউ কম বেশী জনপ্রিয় হলেও জ্ঞানদাস গোবিন্দদাস বলরাম দাসের মতো কাব্যপ্রতিভা তাঁদের ছিল না।  এঁরা ছাড়াও নয়নানন্দ, দেবকীনন্দন, পুরুষোত্তম, জগন্নাথদাস, কানুদাস প্রভৃতি পদকর্তাদের উল্লেখ করা যেতে পারে।

সপ্তদশ শতকের বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের প্রথমে যাঁদের নাম আসে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শ্রীনিবাস-নরোত্তম-শ্যামানন্দ।  শ্রীনিবাস সুদক্ষ কীর্তনগায়ক ছিলেন এবং মনোহরশাহী ঘরানার কীর্তনের প্রবর্তক ছিলেন।  বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে তাঁর কয়েকটি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদের সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলির মধ্যে ধ্বনিঝংকার, রূপকল্প এবং অলংকারের সার্থক সন্নিবেশ লক্ষ্য করা যায়।  নরোত্তম ছিলেন যথার্থই কবি।  তাঁর প্রার্থনা বিষয়ক পদগুলিতে ভক্তির গভীরতা ও প্রাণের আকুতি ছিল অতুলনীয়।  শ্যামানন্দের ভাষা ছিল সুললিত, গভীরভাব সমন্বিত। গোবিন্দ আচার্যর পদগুলি বেশ সরল। তিনি গোবিন্দদাসের ভনিতা ব্যবহার করেছিলেন। অপরদিকে গোবিন্দ চক্রবর্তী বাংলা পদাবলী রচনায় অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন।  তাঁর কাব্যে অসাধারণ ধ্বনিঝংকার আছে। গোবিন্দদাসের ঈষৎ পরবর্তীকালের কবিদের মধ্যে রায়শেখর ছিলেন অন্যতম। তিনি গোবিন্দদাসের আদর্শেই পদ রচনা করেন।  ব্রজবুলি বাংলা এবং ধামালির মতো চালে তিনি পদ রচনা করেন।  রায়বসন্ত নরোত্তম ঠাকুরের শিষ্য ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পদ রচনা সহজ সরল এবং সরস।  তাঁর পদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।  কবিরঞ্জন বিদ্যাপতি ছিলেন শ্রীখন্ডে রঘুনন্দনের শিষ্য।  বিদ্যাপতির ভনিতায় সরল বাংলা পদগুলির রচয়িতা ছিলেন তিনি।  এছাড়াও অপ্রধান পদকর্তাদের মধ্যে গোপাল দাস বা রামগোপাল দাসের কতগুলি পদ পাওয়া যায়।  ঘনশ্যাম দাস বা নরহরি চক্রবর্তী বেশকিছু উৎকৃষ্ট পদ রচনা করেন।  এছাড়াও সম্প্রতি জগদানন্দ এবং শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যসমূহ প্রসাদদাস, রাধাবল্লবদাস শ্যামদাস প্রমুখ বেশ কিছু পদ রচনা করেন। ‘ক্ষণদাগীতচিন্তামণি’র সংকলক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীও বেশকিছু পদ রচনা করেছিলেন। 

বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সংকলনে সপ্তদশ শতকের বহু কবির পরিচয় পাওয়া যায়।  শ্রীনিবাস আচার্যের প্রপৌত্র  রাধামোহন ঠাকুরের বিপুল পদের সম্ভার পাওয়া যায়  পদামৃতসমুদ্র মধ্যে । গোকুলানন্দ সেন বা বৈষ্ণবদাস ‘পদকল্পতরু’ সংকলক এবং নিজে বেশকিছু উৎকৃষ্ট পদ রচনা করেছিলেন।  এই শতাব্দীতে পুরাতন রীতির পদকর্তাদের মধ্যে ছিলেন গোকুলানন্দ চন্দ্রশেখর দাস ও কাঞ্চন দাস, বিশ্বনাথ দাস প্রমূখ অষ্টাদস শতকের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা। প্রেমদাস বা পুরুষোত্তম মিশ্র ঊনবিংশ শতাব্দীতেও এই ধারা বজায় ছিল।  রাজেন্দ্রলালের প্রপিতামহ পীতাম্বর দাস ও পিতা জন্মেজয় মৈত্র বেশকিছু উৎকৃষ্ট পদ রচনা করেছিলেন।  জন্মেজয় মিত্র সঙ্কর্ষণদাস ভনিতায় পদ রচনা করেন।  মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ বৈষ্ণব ভাবনার প্রতিফলন।  কিশোর রবির ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ বিদ্যাপতির পদাবলীর সার্থক অনুসরণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − ten =